কৈবল্যধামে হত্যাযজ্ঞের দাগ এখনো যেন তাজা

0
দিন-তারিখ সঠিকভাবে কেউ জানেন না। তবে এটা সবাই জানেন ১৯৭১ সালের মার্চের শেষে অথবা এপ্রিলের শুরুর দিকের ঘটনা হবে। এক দুপুরে হঠাৎ পাহাড়তলীর মালিপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দেয় পাক হানাদারবাহিনী। ঘরবাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে মানুষজন প্রাণপণে ছুঁটতে থাকেন পাশের কৈবল্যধাম আশ্রমের দিকে। কিন্তু সেখানেও রক্ষা নেই। হানাদারবাহিনী আশ্রমে গিয়েও তান্ডব চালাতে শুরু করে। মানুষজন তাই এদিক-ওদিক পালাতে থাকে। তবে প্রিয় আশ্রম ছেড়ে যাননি মহারাজ তৃতীয় মোহন্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়সহ ২৪ জন। ওইদিন রাতেই ভেসে আসে একের পর এক গুলির আওয়াজ। সেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় সবার বুক। অনেকদিন ধরে সেখানেই পড়েছিল তাঁদের ছিন্নভিন্ন দেহ।

দীর্ঘ সিঁড়ি মাড়িয়ে আশ্রমের মূল ভবনের প্রবেশমুখে হাতের ডানপাশে একটা কালোবোর্ড। তার ওপরে সাদা অক্করে লেখা একে একে ২৪ জনের নাম। তালিকায় আছেন মোহন্ত থেকে পূজারি; পাচক থেকে নিরাপত্তারক্ষী। ওপরে লেখা ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের তালিকা ও পরিচয়।’ সেই ভবনের দোতলায় উঠতেই চোখ আটকে যায় নামফলকে। ফলকের মাঝখানে গুলির ক্ষতচিহ্নটা ৪৯ বছর পরেও এত স্পষ্ট যেমনে হয় এই তো কদিন আগের। স্মৃতিরক্ষায় সেই দাগে কোনো প্রলেপ লাগায়নি আশ্রম কর্তৃপক্ষ। লাগাবে না কেনোদিন।

সেটির বর্ণনা দিতে গিয়ে যেন কেঁপে ওঠে আশ্রমের পুরোহিত সনজিৎ ভট্টাচার্যের বুক। আবেগ সামলে পূর্বকোণকে তিনি বলেন, নামফলকের কক্ষটি ছিল তৃতীয় মোহন্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের। তাঁকে লক্ষ্য করেই হয়তো হানাদারবাহিনী গুলি ছুঁড়েছিল। স্মৃতিরক্ষায় সেই গুলির দাগ এখনো তাজা রেখে দেওয়া হয়েছে।

সনজিৎ ভট্টাচার্য সেই গণহত্যার ঘটনার চিত্র তুলে ধরেন পূর্বকোণের কাছে। বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাক হানাদারবাহিনী। হত্যার পর কয়েকমাস পর্যন্ত লাশগুলো পড়েছিল আশ্রমের এখানে-ওখানে। কয়েকমাস পরে হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাশে সমাহিত করা হয়। এটি চট্টগ্রামের অন্যতম বড় গণহত্যা হলেও স্মৃতিরক্ষায় সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একটা স্মৃতিস্তম্ভ তো অন্তত করা যেত।

সেদিনের ঘটনার সাক্ষীদের প্রায় সবাই মারা গেছেন। তবে মালিপাড়ায় পাওয়া গেল একজনকে। তিনি সুনীল চন্দ্র দাশ। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী তাঁকে জানে না মারলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছেন। পায়ে বুট দিয়ে মারা আঘাতের রেশে তিনি এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটেন। মাথায় বন্দুক দিয়ে মারায় কপালের ওপর সৃষ্ট আলুসদৃশ ফোলা এখনো দৃশ্যমান। কানেও শোনেন না তেমন।

সুনীল শোনান সেদিনের ঘটনা। হত্যাযজ্ঞের দিন দুপুর। হঠাৎ পাক হানাদারবাহিনী মালিপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দিলে সবাই আশ্রমে আশ্রয় নিতে ছুঁটতে থাকেন। একেবারে শেষেরদিকে আশ্রমে ঢুকতে যাচ্ছিলেন সুনীল। ততক্ষণে হানাদারবাহিনীও আশ্রমের গেটের গোড়ায়। সুনীলকে ঢুকতে দেখেই আটকায় তারা। বলে ওঠেন ‘কেদার যায় গা।’ আশ্রমের দিকে আঙ্গুল দেখাতেই সুনীলের ডান পায়ে সজোরে বুটের লাথি। মাথায় পড়ল বন্দুকের নলের আঘাত। হতচকিত সুনীল কোনোমতে কাট্টলির দিকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।

সুনীল বলেন, ‘তৃতীয় মোহন্ত মহারাজসহ অনেকেই আশ্রম ছেড়ে যাননি। পরদিন সকালে শুনি তাঁদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আমরা আশ্রমের দিকে আসতে চাই। কিন্তু পুরো এলাকা হানাদারবাহিনী ঘিরে রাখায় আর আশ্রমমুখি হতে পারিনি কেউ।’

এখন প্রতিদিন পূজারীদের ভিড় নামে আশ্রমে। নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান লেগে থাকে দিনভর। তার মধ্যে ওই কালোবোর্ডে নজর পড়লেই মুহূর্তেই চোখ ভিজে ওঠে অনেকের। বাইরে থেকে আসা পূজারীদের কেউ কেউ তখন প্রশ্ন ছুঁড়েন, ‘নিরপরাদ মানুষকেও এতটা নির্দয়ভাবে মারা যায়?’

Share.

Leave A Reply