কক্সবাজার থেকে হারিয়ে গেল ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসসহ দুরারোগ্য রোগের মহৌষধ ঐতিহ্যবাহী ‘কালা বিনি’

0
একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি গ্রামের ধানক্ষেতে দেখা যেত ‘কালা বিনি’ নামের এক প্রকার কালো জাতের ধানের। আর যে গ্রামে এই বিশেষ কালো ধানটির চাষ হত; সেই গ্রামটি ধানের শীষের সুগন্ধে মৌ মৌ করত। কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এটি ‘কালা বিনি’ নামে পরিচিত হলেও কেউ কেউ ‘পোড়া বিনি’ নামেও চেনে। কিন্তু গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই ধানটি কক্সবাজার জেলা থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এর ক্যান্সারবিরোধী ও ডায়াবেটিস বিরোধীসহ মূল্যবান ওষুধীগুণের তথ্য জানার পর বিশ্বব্যাপী ‘কালা বিনি’র চাষাবাদ ও চাহিদা বাড়ছে। 
বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যান্থোসায়ানিন নামের একটি বিশেষ রাসায়নিক যৌগের কারণে এই ধানের চালের রঙ কালো হয়। আর অ্যান্থোসায়ানিন-ই ক্যানসার ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাছাড়া বার্ধক্য, স্নাযুরোগ, ডায়াবেটিস ও  ব্যাক্টেরিয়া-সংক্রমণ প্রতিরোধেও অ্যান্থোসায়ানিনের জুড়ি মেলা ভার। এই চালে আয়রন ও ফাইবার বেশি, অথচ শর্করা কম। শর্করা কম মানে ডায়াবেটিস রোগীর আদর্শ পথ্য। এ চালের গন্ধ প্রায় গোবিন্দভোগের মত।
তবে গত প্রায় একমাস ধরে জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় খোঁজ নিয়ে কোথাও কালা বিনির চাষ হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এই ঐতিহ্যবাহী ধানটি কক্সবাজার জেলার কোথাও চাষ হতে এখন আর দেখা যায় না বলে জানান কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কাশেমও।
তিনি বলেন, একসময় চকরিয়াতে চাষ হত বলে শুনেছি। এখন কক্সবাজার জেলার কোথাও চাষ হওয়ার খবর পাওয়া যায় না।
একইভাবে একসময় চকরিয়ার পাশ্ববর্তী পার্বত্য লামা-আলীকদমেও কালা বিনির ব্যাপক চাষ হত, কিন্তু এখন সেখান থেকেও ধানটি হারিয়ে যেতে বসেছে বলে জানান লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, এখন লামা-আলী কদমের কোথায় ‘কালা বিনি’র চাষ হচ্ছে; তা দেখতে সেখানে হেলিকপ্টার নিয়ে যেতে হবে।
চকরিয়ার কৃষক রশীদ আহমদ বলেন, একসময় আমরা নিজেদের খাওয়ার ও অতিথি আপ্যায়নের জন্যই কালাবিনির চাষ করতাম। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনের কারণে আমরা কালাবিনির চাষ করি না। ফলনে কম হয় বলে বর্গাচাষীরাও এই ধানের চাষ করে না।
একই তথ্য জানান রামুর জোয়ারিয়ানালা পূর্বপাড়ার বাসিন্দা ও কক্সবাজারের বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট এস্তেফাজুর রহমান। তিনি বলেন, একসময় শ্রমিকের মজুরী ছিল কম। তাই জমির মালিকরা নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য কালাবিনির চাষ করতেন। কিন্তু গত প্রায় ৩ দশকে এই অঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন ও কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে এই ধানটি আর চোখে পড়ছে না।
কক্সবাজার চেম্বার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, একসময় কক্সবাজারের গ্রামগুলো কালাবিনির মৌ মৌ সুগন্ধে মুখর হয়ে থাকত। নতুন ধান কাটার পর কালা বিনি চাল দিয়ে নারকেলের পাটিসাপ্টা, পায়েসসহ নানা রকম পিঠা ও খাবার তৈরি করা হত। তা এখন কেবলই স্মৃতি।
তবে কক্সবাজার থেকে কালা বিনি হারিয়ে গেলেও কক্সবাজারের রামুর পাশ্ববর্তী পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির কিছু এলাকায় এখনও ধানটি চাষ হচ্ছে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিউল্লাহ ও নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন কচি।
তারা জানান, পার্বত্য উপজেলার বাইশারী ও দোছড়িসহ আরো কিছু এলাকার জুমিয়ারা এই ধানের চাষ করছে।
দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য থোয়াইংচি অং জানান, মুরং, মার্মা, চাক ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদের উৎসবের জন্যই ঐতিহ্যগত এই ধানের চাষ করে।
‘কালা বিনি’ নামে পরিচিত এই কালো চালের বহুমুখী উপকারিতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন বিশিষ্ট মেডিসিনি বিশেষজ্ঞ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইউনুছ। তিনি বলেন, আমি নিজেই এই চালের নিয়মিত ভোক্তা। কালো চালে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধী। এ ছাড়া হৃদরোগের সুস্থতা বজায় রাখা, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ানো ও শারীরিক ব্যথা নিরাময়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিশেষ কার্যকর।
তিনি বলেন, এখন বিশ^ব্যাপী পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। শুধু নিয়মিত খাদ্য গ্রহণই শেষ কথা নয়, সেই খাদ্যের সঙ্গে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী কতটুকু পুষ্টিকর উপাদান আমরা গ্রহণ করছি তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই হবে আমাদের জন্য অনেক এক বড় অর্জন।
বিন্নি বা বিনি ধানের বিভিন্ন জাত রয়েছে। যেমন: চন্দন বিন্নি, গেং গেং বিন্নি, মৌ বিন্নি, দুধ বিন্নি, রাঙা বিন্নি, আসানিয়া বিন্নি, ছৎছেৎ বিন্নি, বিজাবিরাং বিন্নি, কুৎচিয়া বিন্নি, আগুনিয়া বিন্নি, কাক্কুয়া বিন্নি, চিচাও বিন্নি, লেদার বিন্নি, লোবা বিন্নি, কবা বিন্নি, হরিণ বিন্নি, লক্ষ্ণী বিন্নি, দরিমা বিন্নি, গারো বিন্নি, কাঁশিয়া বিন্নির নাম উলেস্নখযোগ্য। তবে বর্তমানে বিন্নি চালের রঙ অনুসারে লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি, কালো বিন্নি এই তিন ধরনের বিন্নিই সুপরিচিত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙালী সকলেই বিন্নি ধানকে ‘বিনি ধান’ বলে থাকে। তবে আঠাঁলো জাতের ভাত ও কালো রঙের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই চালটি ‘কালা বিনি’ নামে পরিচিত হলেও এটি আসলে বিরুণ চাল বলে জানান কৃষিবিদরা।
কৃষিবিদদের মতে, কালো ধান আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কালামানিক, কালিমুগা, কালাবিন্নি, কালি আমন, কাজলা, কালোজিরা, কাজলশাইল, কালা বালাম প্রভৃতি নামের প্রায় ৯০টির মতো জাতের কালো ধান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট চিহ্নিত করেছে। তবে সুগন্ধ ও স্বাদের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে উৎপাদিত কালাবিনির চাহিদাই আলাদা।
কক্সবাজার কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, বিন্নি ধান পাহাড়ি-সমতল উঁচু নিচু সব ধরনের জমিতেই চাষ হয়ে থাকে। এ ধান চাষাবাদ করতে কোন রাসায়নিক সার বা বিষের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী একটি ধান কক্সবাজার থেকে হারিয়ে যাওয়া অত্যন্ত দু:খজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম কালো চালের ভাতে সাধারণ চালের তুলনায় আমিষের পরিমাণ প্রায় ৮.৫ গ্রাম বেশি। জিংকের পরিমাণও বেশি। কালো চাল ভিটামিন ‘ই’-সমৃদ্ধ। এটি আমাদের চোখ, ত্বক ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কালো চালের ভাত শরীরের বিষাক্ত বর্জ্য ও লিভারের ক্ষতিকারক পদার্থগুলো দূর করে দিতে সক্ষম। কালো চাল শরীরে বিদ্যমান শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক; যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই জরুরি।
কথিত রয়েছে, চতুর্দশ-সপ্তদশ শতকে মিং যুগের চিনে এর চাষ হতো। কিন্তু রাজা ও রাজ পরিবারের সদস্যেরা ছাড়া কালো ভাত মুখে তোলার অধিকার কারও ছিল না। কালো ধানের চাষ প্রজাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। তাই এর আরেক নাম ফরবিডেন রাইস বা নিষিদ্ধ চাল। পরবর্তীতে এই চালটি জাপান ও মায়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে। আর মায়ানমার থেকে আসে বৃহত্তর চট্টগ্রামে। বর্তমানে বিশ্বে কালো চালসমৃদ্ধ ২০০ ধানের জাত আছে। এর মধ্যে চীনের হাতেই আছে ৬০ শতাংশের বেশি। চীন ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও ফিলিপিন্সে এ ধরনের ধান আবাদে চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের কুমিল্লাতেও নতুন করে এ ধানের চাষ হচ্ছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী কালা বিনিকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। এ ধানের চাষ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
Share.

Leave A Reply