শীতের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য আড়মোড়া ভেঙে তাপ ছড়াতে শুরু করেছে কেবল। এর মধ্যেই কবুতরের ক্লান্তিহীন বাকবাকুম-বাকবাকুম ডাক শুনে দৌড়ে দোতলার ছাদে ওঠে আলিফ মাহমুদ সাহিল। কবুতরের ডেরায় চোখ পড়তেই দেখতে পায় অন্য কবুতরের সঙ্গে সেখানে অচেনা এক পাখি। তারপর সে ডেকে আনে মামা মোহাম্মদ মিজান হোসেন ফরহাদকে।
দুজনে আটকে পড়া পাখিটিকে পরম মমতায় নিচে নামিয়ে আনেন। মুখে খাবার তুলে দিতেই ক্ষুধার্ত পাখিটা গপ গপ করে খেয়ে ফেলে। পরে উড়িয়ে দিতে চাইলেও পাখিটা আর যেতে চায় না। হয়তো উদ্ধারকারীদের মায়ার টানে বাঁধা পড়ে গেছে। তাই এখন বাড়ির একটি বড় খাঁচাই হয়ে উঠেছে তার ঠিকানা। কিন্তু এভাবে তো পাখিটাকে রাখা যাবে না। সেজন্য মোহাম্মদ মিজান হোসেন চান চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে পাখিটাকে হস্তান্তর করতে।
বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর উত্তর কাট্টলির কালিরহাটের মোশারফ আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায় অচেনা সেই পাখিটিকে। পালকজুড়ে ঘাড় বাদামি রং। মুখ থেকে বাকি শরীরে দুধ-সাদার ওপর অবিন্যাস্ত বাদামি রংয়ের প্রলেপ। সঙ্গে শিকারি ঠোঁট আর নখ তো আছেই। খাঁচার দরজা খুলতেই মিজান হোসেনের হাতের ওপর এসে বসে ক্যামেরার দিকে তাকায় পাখিটি। মোহাম্মদ মিজান হোসেন ফরহাদ পূর্বকোণের কাছে তুলে ধরেন সেই দিনের অভিজ্ঞতা।
৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পাখিটি কবুতরের বাসায় ঢুকে পড়ে। হয়তো ক্ষুধার্ত ছিল তাই কবুতরের বাচ্চা খেতে আসা। পরে সেটিকে সেখান থেকে নামিয়ে দেখেন পায়ে রিং পরানো। এতে বুঝে যান কারো ঘরে ছিল পাখিটি। হয়তো কোনো কারণে সেখান থেকে চলে এসেছে। কিন্তু রিংয়ের কারণে পাখিটি ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে পারছে না।
আলাপ বাড়তে থাকে মোহাম্মদ মিজান হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাখিটিকে তিনি চিনতে পারেননি। পরে পাখিপ্রেমিক হিসাবে পরিচিত ঢাকার ফিরোজ রেজার কাছে পাখিটির ছবি পাঠান। ফিরোজ রেজা জানান এই পাখিটির নাম- কারনিভোরস ব্রাহমিনি কাইট (ঈধৎহরাড়ৎবং নৎধযসরহু শরঃব)। গুগল ঘেঁটে তার সত্যতা মিলল। উইকিপিডিয়া বলছে, এটি মূলত শিকারি পাখি। ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই পাখিটির দেখা মেলে। অস্ট্রেলিয়ায় লালচে সামুদ্রিক ঈগল নামে পরিচিতি আছে পাখিটির। মূলত উপকূল ও জলাভূমিতে মরা মাছ আর অন্যান্য খাবার খেয়ে তারা বাঁচে। তবে সৌখিন পাখি হিসাবেও এই পাখিটি এখন অনেকের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
এই কদিনে যেন বাড়ির সদস্য হয়ে গেছে পাখিটা। এই ‘অতিথির’ পেছনে যত্নআত্তিরও কমতি রাখছে না ঘরের সদস্যরা। সকাল-বিকেল কয়েক পদের মাছে চলছে তার পেটপূজা। মোহাম্মদ মিজান হোসেন তাই হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি ডায়েটে আছি। তাই মাছ-মাংস ছুঁতে মানা। কিন্তু পাখিটির জন্য এখন কয়েক পদের মাছ কিনতে হচ্ছে।’
এদিকে, পাখিটিকে দেখতে আসছেন অনেকেই। এর মধ্যে এক সৌখিন পাখিপালক সেটি কিনতে ১০ হাজার টাকা দামও হাঁকিয়েছেন। তবে মোহাম্মদ মিজান হোসেন চান না পাখিটিকে বিক্রি করতে।
পাখিটাকে আগলে রাখা এই তরুণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘জোরাজুরি করলে হয়তো পাখিটি চলে যাবে। কিন্তু সেভাবে গেলে পাখিটি কোনো শিকারির হাতে পড়তে পারে। পায়ে আঘাত থাকায় জীবন বিপন্নও হতে পারে। আবার পাখিটির মায়ায় পড়ে গেলেও তো চাইলে পাখিটিকে স্থায়ীভাবে বাসায় রাখতে পারব না। কারণ আইনের ফাঁদে পড়ে যেতে পারি। তাই চাচ্ছি চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করতে। সেখানে গেলে হয়তো পাখিটি ভালো থাকবে।’
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা পরিচালনা পরিষদের সদস্যসচিব ও হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমিনও আগ্রহ দেখালেন পাখিটির বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা যোগাযোগ করে পাখিটিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। এরপর চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনায় পাখিটিকে ভালো রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।’