রাঙ্গুনিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার : মা’কে ফাঁকি দিয়ে আধাসের চিড়া-গুড় ও হাতঘড়ি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বেড়িয়ে পড়েন

0
সালটা ১৯৭১। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়। ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমার মানসভূমিকে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বুনবার জন্য উর্বর করে তুলেছিল। তখন বাংলার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের ঘনঘটা। সর্বশেষ ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এটি আমার চিত্তকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে ও উজ্জীবিত করে।
মার্চের ২৫ থেকে শুরু হল নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর পাকিস্তানী সেনাদের পাশবিক আক্রমন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা দিন দিন বেড়ইে চলছিল। লেখাপড়ায় আর মনসংযোগ করা সম্ভব হচ্ছিলনা। মনস্থির করি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেশকে হানাদার মুক্ত করতে হবে। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝিতে নিজেকে শারিরীক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে ফেললাম। তখন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া রাজারহাট ফরেস্ট অফিসে বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবকরা এসে জড়ো হচ্ছে এবং ভারতে পাড়ি দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। এদিকে পরিবারে আমর মা এবং অন্যান্যরা কড়া নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে আমার ওপর। তারমাঝেও মাকে ফাঁকি দিয়ে সংগোপনে ও অগোচরে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম পালাবার। একদিন দুপুর বেলা ২ টা কি আড়ইটা, একটি ছোট্ট ব্যাগে লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্ট এরসাথে আধাসের চিড়া ও গুড় এবং বাবার দেয়া একটি হাতঘড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। তখন পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি গ্রামের বাবা কল্যান তালুকদার ও মাতা ডলি রাণী তালুকদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার ছিল সবার বড়।
পদুয়া ফরেস্ট অফিসে পৌঁছে দেখলাম আমার মতো আরো শত শত তরুণ-যুবক দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে জড়ো হয়েছে। একদিন বিকেল বেলা ৩০-৩৫ জনের একটি দল পার্বত্য রাজস্থলী উপজেলার শ্বাপদ সংকুলান পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু করলাম। দিনরাত পায়ে হেঁটে দীর্ঘ ১২ দিন পর আমরা ভারতের মিজোরাম প্রদেশের দেমাগ্রী পৌঁছলাম। পাহাড়ি জঙ্গলে বিরামহীন পথচলার সময়ে বেঁচে থাকার জন্য আমার কাছে আধাসের চিড়া ও গুড় ছিল সম্বল।
মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার জানান, দেমাগ্রী শরাণার্থী ক্যাম্পে কিছুদিন অনাহারে অর্ধাহারে অতিবাহিত করার পর ঘোষণা করা হল প্রশিক্ষণের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক যুবক রিক্রুট করা হবে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোক উপস্থিত হওয়ায় শারিরীক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হল। পরীক্ষার বিষয় হল সাঁতরে খরস্্েরাতা কর্ণফুলি নদী পারাপার এবং ১৫ মিনিটে দুই মাইল দৌড়ানো। এত যারা সফল হয়েছে তাদেরই নেয়া হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে লক্ষ্য করলাম, ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক, শ্রমিক, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সমারোহ। আমাদের ঠাঁই হল শরণার্থী শিবির হতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যারাকে। শুরু হল নিয়মিত হাড়ভাঙ্গা ট্রেনিং। ভোর সাড়ে চারটায় হুইশেলের শব্দ শুনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে মাঠে হাজির হওয়া, জগিং এবং মুক্ত হস্তে ব্যায়াম। ব্যায়াম শেষে ব্যারাকে ফিরে প্রাতরাশ পর্ব সেরে মাঠে কুচকাওয়াজ এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণ। অস্ত্রের মধ্যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, গ্রেনেড, এসএল আর, এলএমজি বিস্ফোরক ইত্যাদি। বাঙালি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ট্রেনিং করাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ভারতীয় প্রশিক্ষক বা কোন কর্মকর্তার কাছে কোন অভাব অভিযোগ নিয়ে গেলে তাঁদের একটাই জবাব ছিল “পয়দা করো”। কোন সমাধান পেতামনা, নিজেরাই সমাধান খুজে বের করতাম। এভাবে রুটিন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ চলতে লাগল। এরমধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর কাজ ছিল পানীয় জল সংগ্রহ করা। পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে প্রায় ৫০০ ফুট উপরে ক্যাম্পে তোলা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার ছিল। এসময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণার্থীকে কান্না করতে দেখা গেছে। তবে প্রশিক্ষকদের মধ্যে হাবিলদার হামিদ ওস্তাদের মন্তব্য আমরা বেশ উপভোগ করতাম। প্রায় মাসাধিককাল ট্রেনিংযের পর নির্দেশ আসল আগরতলা যাওয়ার । সুদীর্ঘ পার্বত্য উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এসে সেখান থেকে শিলচর হয়ে আগরতলার বগাপাহাড় ক্যাম্পে পোঁছায় আমরা। সেখানে আরো কিছুদিন নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর হরিনা ট্রানজিট ক্যাম্পে আসি। হরিনাতে আমাদেরকে অস্ত্র দেয়া হয়। আমাকে দেয়া হয় ১টি এসএলআর, গুলি এবং কিছু গ্রেনেড। বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে আমাদের দলের দায়িত্ব গ্রহন করলেন খোদা বক্স চৌধুরী। রামগড় সীমান্ত দিয়ে ফটিকছড়ি, হাটহজারী রাউজানের পাহাড়ি পথ ধরে আমরা রাঙ্গুনিয়ায় চলে আসি। আসার পথে ফটিকছড়ির নারায়নহাট সংলগ্ন যোইগ্যাছোলা পাহাড়ে আমাদের দল পাকিস্তানি আর্মিদের এম্বুসের রেঞ্জে পড়ে গিয়েছিলাম। সম্ভবত এই পথে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে ফেরার সংবাদে তারা অবস্থান নিয়েছিল। একজন পাহাড়ি উপজাতীয় ছেলে কিছু আগে আমাদের খবর বলাতে আমরা রক্ষা পায়। নাহলে সেদিন আমাদের সবারই জীবন অনিশ্চিত হয়ে যেত। কারণ পাকি সৈন্যদের মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিলনা। রাঙ্গুনিয়া এসে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া পুলিশের সাবেক এআইজি (অবঃ) নুরুল আলম এবং ছালেহ আহমদ এর গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হই।
রাঙ্গুনিয়া পৌঁছে এই মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার খোদা বক্স চৌধুরী ও ডেপুটি কমান্ডার আহমদুল হকের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়ক ও চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়কে পাকিস্তানী সেনাদের অবাধ চলাচল ও রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষন ও লুন্ঠনে বাঁধা সৃষ্টিতে সাহসী ভুমিকা রাখেন। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে বিদ্যুতের টাওয়ার ধ্বংস, সরফভাটার চিরিঙ্গা পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে কর্ণফুলি নদী পথে পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচলের সময় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর আবারো পড়ালেখায় মনযোগী হয়ে উঠেন মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার। রাঙ্গুনিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাশ করে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে যোগ দেন কর্ণফুলি পোপার মিল (কেপিএম) স্কুলে শিক্ষকতা পেশায়। ৩১ বছর সেখানে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে অবসর নেন দেশমাতৃকার যুদ্ধে জয়ী হয়ে মানুষ গড়ার কারিগর প্রসেনজিত তালুকদার। অবসর জীবনেও থেমে নেই এই মুক্তিযোদ্ধার জীবন সংগ্রাম। তিনি বর্তমানে রাঙ্গুনিয়া পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন সফলতার সাথে। #
Share.

Leave A Reply