এম এ হোসাইন ঃ ভারতের আগ্রার তাজমহল দেখে বাড়ি বানানোর ইচ্ছা ছিল তাঁর। বাড়ির মাঝখানে থাকবে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ। এই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন মনছপ আলী।
সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার সহচর ছিলেন মুকিম চৌধুরী। মুকিম চৌধুরীর বংশধর মনছপ আলী। নান্দনিক ভবনটিকে স্থানীয়রা ‘বড় বাড়ি’ নামে চেনে। ‘সাহেব বাড়ির ইতিহাস’ বই থেকে এ তথ্য জানা যায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের পূর্ব সরফভাটা গ্রামের ১২টি কক্ষের বাড়ির মাঝখানে বড় বাড়ির প্রাচীন নান্দনিক এই মসজিদ। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ার গোডাউন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সরফভাটা ইউনিয়নের পূর্ব সরফভাটা গ্রামে এখান সহজে যাওয়া যায়।
সম্প্রতি ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আগ্রার তাজমহলের আদলে বানানো বাড়িটির মাঝখানে নির্মিত মসজিদটি অনেকটা ধুলাবালুতে ছেয়ে গেছে। পুরো বাড়ি ঘিরে গাছপালা। বিবর্ণ মসজিদসহ পুরো বাড়ি। সদর ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল বাড়ি তালা দেওয়া। ভবনের পশ্চিম পাশ থেকে দরজার ফুটো দিয়ে দেখা যায় ভেতরে প্রচুর ময়লা। বাড়ির ভেতর থেকে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য দুই পাশে দরজা। মূল ফটক থেকে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে দুটি দরজা।
পুরোনো ঘরে থাকেন মুকিম চৌধুরীর বংশধর তৌসিফ চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দালানের সামনে ও পেছনের দিকে দেখতে একই রকম। আমার পূর্বপুরুষেরা তাঁদের পরিবার নিয়ে নামাজ পড়তে দালানের মাঝখানে মসজিদটি তৈরি করেছেন। পরবর্তী সময়ে গ্রামের প্রতিবেশীরা এই মসজিদে প্রতিদিন নামাজ পড়েন। মসজিদে জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে এটির সামনে আরেকটি মসজিদ তৈরি করা হয়। বর্তমানে পুরোনো মসজিদে আর নামাজ পড়া হয় না। তবে মাঝে মাঝে মসজিদটি খোলা হয়।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রবীণ স্কুলশিক্ষক মো. নুরুল হুদা বলেন, ‘পুরোনো ভবনটি দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। হঠাৎ করে কেউ গ্রামে আসলে বাড়িটি দেখে চমকে যান। ভবনটি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে এটি টিকিয়ে রাখা দরকার।’
স্থানীয় প্রকাশনা ‘সাহেব বাড়ির ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সুজা খাঁর বিশ্বস্ত সহচর মুকিম চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। সে সময় তাঁর পুত্র এয়ার আলী রাউজানের খৈয়য়ালী থেকে চার সন্তান নিয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের শ্বশুরবাড়ির পাশে একটি ছোট বসতঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি মারা যাওয়ার ফলে পরিবারে নেমে আসে অভাব–অনটন। ওই সময় তাঁর বড় ছেলে সৈয়দ আলী মামার কাছ থেকে ব্যবসার জন্য এক টাকা নিয়ে মধু বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। তারপর থেকে তাঁর ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে।
চার ভাই সৈয়দ আলী, আমান আলী, রশিদ আলী ও ইউছুপ আলী মিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জমি কেনেন। ছৈয়দ আলী এলাকায় রাস্তা, মসজিদ-মাদ্রাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিদেশে প্রথম তুলা রপ্তানি করেন তাঁরা। ১৯৪৭ সালে ছৈয়দ আলীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা মিলে একসময়ের মনসফ আলী বি এ অ্যান্ড ব্রাদার্স মিলে ব্যবসায়িক কোম্পানি গঠন করেন। সে সময় মনছপ আলী চৌধুরী ও তাঁর ভাইয়েরা মিলে এই ‘ছৈয়দ আলী ভবন’ নামে ভবনটি নির্মাণ করেন। মনছফ আলী চৌধুরী, জরিফ আলী চৌধুরী, নাদের আলী চৌধুরী, শামসুদ্দীন চৌধুরী, কামাল উদ্দীন চৌধুরী এই পাঁচ ভাইয়ের ব্যবসা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের এ ব্যবসার মধ্যে অন্যতম একটি হলো জাহাজ ও লঞ্চের যাত্রী ও মালামাল পরিবহন।