ড. নাজনীন বেগম «
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চির প্রস্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ জীবনের সৃষ্টি ও কর্মযজ্ঞের যবনিকাপাত হয়। যে শৈল্পিক ও নান্দনিক দ্যোতনা আবহমান বাংলার কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বর্ণাঢ্য সম্পূরণ তা যুগ থেকে যুগান্তরের ধারায় এখন অবধি বহমান। সঙ্গত কারণে রবীন্দ্রনাথ সমকাল কিংবা আধুনিক নন, বরং একেবারে চিরকালের। উল্লেখ করা যেতে পারে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও গবেষক প্রমথনাথ বিশীর একটি অভিমত- তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, অতি বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ অতি তরুণও বটে। অদ্যতনের রবীন্দ্রনাথের মধ্যে চিরন্তনের বোধ খুঁজে পাওয়া অতি সহজ। রবীন্দ্রনাথের শিল্পধর্ম সঙ্গত রূপ মাধুর্য সেই কারণেই আধুনিকতাকেও উত্তরণ করে যায়।
২২ শ্রাবণ বর্ষণমুখর এক দিন। সেদিনের প্রকৃতির বর্ণনা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘রবি হারা’ কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে
উদাস গগন কোলে
তুমি চলে যাবে বলে…
তব ধরিত্রী মাতার রোদন তুমি শুনিয়াছিলে নাকি…
আমরা সবাই জানি বর্ষা কবির সর্বাধিক প্রিয় ঋতু। সেই বাল্যকাল থেকে। ১৯১২ সালে যখন ‘জীবন স্মৃতি’ লিখছেন সেখানে বর্ষার বন্দনা করেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ‘কেবল মনে পড়ে জল পড়ে, পাতা নড়ে। আমার জীবনে এটাই আদি কবির আদি কবিতা। আর মনে পড়ে বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান। এই ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।’ প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়- বাংলার বর্ষা রবীন্দ্রনাথেরই আবিষ্কার।
তেমন এক বারি স্নাত সিক্ত প্রকৃতির পরশে কবির অনন্ত যাত্রা শ্মশানে গিয়ে পৌঁছায়। কলকাতার নিমতলীর শ্মশান। সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের জটিল চিকিৎসা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতেই সম্পন্ন হওয়ার বিতর্কিত বিষয়টি আজ অবধি অজানাই থেকে যায়। তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায়, ডা. স্যার নীল রতন সরকারের মতো বিশেষজ্ঞরাই এমন অপারেশন বাসায় করতে সম্মত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে কলকাতা তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেকখানি এগিয়ে। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত পরাধীন ভারতে ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের ছোঁয়ায় আধুনিকতার নির্মাল্যে অত্যন্ত যুগোপযোগী উপহার ছিল। পরবর্তী শতবর্ষ পার হওয়ার সন্ধিক্ষণে কলকাতার চিকিৎসার সমৃদ্ধ বলয়টি আরও কিছু নার্সিং হোম এবং হাসপাতালের স¤প্রসারণ ব্রিটিশ রাজশক্তির অবদান হলেও দেশীয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নত পরিবেশ তাকে অপ্রতিরোধ্য করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবহমান বাংলা ও বাঙালির সম্পদ কবিগুরু যিনি বিশ্বসভা জয় করে তাবৎ দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে বাঙালিকে বৈশ্বিক আঙিনায় দাঁড় করান। শুধু কি তাই? বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথ জীবনভর প্রযুক্তির শেষ অর্জনকে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করতে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করে গেছেন। সেই রবীন্দ্রনাথের অন্তিম সময়ে এমন বিতর্কিত স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন হয়েছিল তা আজও হতচকিত হওয়ার মতো। বিজ্ঞজনেরা বলতে দ্বিধা করেননি- শেষ যাত্রায় নাকি তড়িঘড়ি করে কবিকে নিমতলা শ্মশান ঘাটে নেয়া হয়। অথচ কবির নিজের গড়া তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনেও তাকে দাহ করার যৌক্তিক আলোচনা শেষ হয়েও হতে পারছে না। তার পরেও ২২ শ্রাবণ আমরা স্মরণ করি বাঙালির আপন ঐশ্বর্য যা কিনা বিশ্ববাসীকেও মুগ্ধতার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়েছিল কবির সেই মহাপ্রয়াণের শোকাবহ দিনকে।
কবির শেষ সময় নিয়ে কথা বলতে গেলেই মনে পড়ে যায় তার নিজস্ব বোধ মৃত্যুর ব্যাপারে। মৃত্যুর ভয়াবহতা আর কষ্টকে সেভাবে মানতে পারতেন না। তার পরেও দীর্ঘ জীবনে আপনজনের কত মৃত্যু তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে, সত্যিই এক মর্মান্তিক বিষয়। দেখতে হয়েছে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মৃত্যুর অমৃতময় আলোককেও।
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে মঙ্গল আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি ডেকে আনে অমৃতময় আলোক
তবে তাই হোক।
মঙ্গল-অমঙ্গলের ধারণা ব্যতিরেকেও মৃত্যুকে মানতে না পারার কষ্ট, যন্ত্রণায় বারবার তাড়িত হয়েছেন তিনি।
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
জীবন স্মৃতিতে আছে প্রথম মৃত্যুর উপলব্ধি করেন মাতা সারদা দেবীর চির প্রস্থানের সময়। মাত্র ১৪ বছরের এক কিশোর হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট নিয়ে অনুভব করলেন মা ঠাকুর বাড়ির যে ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন সেখান দিয়ে আর কখনই ফিরবেন না। এটাই কবির জীবনের প্রথম মৃত্যুশোক। ২২ বছর বয়সে সদ্যবিবাহিত এক উদ্দীপ্ত যুবক যখন ২৪ বছরের নতুন বৌঠানের আত্মঘাতী হওয়ার চিত্র হৃদয়ে ধারণ করেন তেমন শোক তো ভোলাও যায় না। তাই বলতে দ্বিধা করেননি অল্প বয়সে অনেক শোক সামান্য হলেও পরে তেমন মৃত্যু চিরস্থায়ী বেদনায় মনের নিভৃতে গেঁথে যায়। নতুন বৌঠান প্রায় সমবয়সী হলেও ২ বছরের বড়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদূষী স্ত্রী। মায়ের মৃত্যুর পর নতুন বৌঠানের তত্ত¡াবধানেই বালক কবির প্রতিদিনের জীবন অতিবাহিত হতো। মৃত্যুশয্যায়ও সৃজনশীল ও শৈল্পিক মহিমা কোনভাবেই আপন মাহাত্ম্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয়নি।
আজীবন এক অদৃশ্য বিশ্বনিয়ন্তা এবং দৃশ্যমান অপরূপ মায়াঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্যে আপ্লæত কবি মানবজীবনের প্রেম ও ভালবাসার বৈচিত্র্যে মিলিয়ে-মিশিয়ে যেভাবে সৃজন সৌধ নির্মাণ করেন তা আজ পর্যন্ত অক্ষয় ঐশ্বর্য, আবহমান বাঙালির চিরায়ত সমৃদ্ধ চেতনা। তার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে আধুনিকতার বরমাল্য, সময়ের যৌক্তিক আবেদন ছাড়াও বিশ্বজনীনতার অপার সমারোহ। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে গীতি ও নৃত্যনাট্য, এমনকি উপন্যাস রচনায়ও তিনি একজন সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। এক অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেয়া কবি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সমৃদ্ধ বংশপরম্পরার ঐতিহ্য ও নান্দনিক শৈল্পিক দ্যোতনা। যা কবিকে নানা মাত্রিকে পরিপূর্ণ করতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখে। জমিদারি দেখার সুবাদে বাংলাদেশের শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসরে আসেন। নদীমাতৃক বাংলার ছায়াঘেরা পল্লীর যে মনোমুগ্ধকর মাধুরী সেটাও কবির অনন্য সৃজন ও মনন শৌর্যে পৌঁছে যায়, যা কালান্তরের বহুবিধ পথযাত্রায় তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়নি।
প্রায়ই ৮০ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়। আজও ভাবতেই পারা যায় না রবীন্দ্রনাথের শারীরিক অনুপস্থিতি। তার সুজন সম্ভারে এখনও তিনি কি মাত্রায় সজীব এবং সরব উপস্থিতি। দুঃখ-শোক, আনন্দ-বেদনায় সকল মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ আজ অবধি কত প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য এ নিয়ে সিংহভাগ মানুষেরই কোনো দ্বিমত নেই। স্বল্প সংখ্যক মানুষ যারা রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন, তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারণও করছেন। তবু স্বীকার করতে কেন জানি দ্বিধান্বিত। মৃত্যু চিরস্থায়ী বেদনা এবং প্রস্থান হলেও কীর্তিমান মানুষরা আপন বৈভবের সম্ভারে কখনও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান না। এমন সব ক্ষণজন্মা মহামানব যুগের ও কালের প্রতিনিধি হয়ে সর্বকালের জন্য আলোকবর্তিকা পৌঁছে দিতেও নিরন্তর কাজ করে যান।
২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্থায়ী প্রস্থানের শেষ গন্তব্যে চলে গেলেন। মৃত্যুকে কখনও মানতে পারেননি। তার পরেও কত আপনজনের নির্মম চলে যাওয়াকে কঠিন চিত্তে মেনেও নিতে হয়েছে। প্রথম জীবনে মৃত্যুর বন্দনা করেছেন কাব্যিক আবহে। মরণকে মিলিয়েছেন শ্যামের সঙ্গে। আবার পৃথিবী ছেড়ে না যাওয়ার আকুতি ও নান্দনিকবোধে অলঙ্কৃত হয়েছেন। নিজের চলে যাওয়ার ক্ষতবিক্ষত অনুর্ভব কতখানি পীড়া দিয়েছে কিংবা সহনীয় হয়েছে তাও অপ্রকাশ্যে থেকে যায়। সৃজনযজ্ঞে বহুমাত্রিক আঙ্গিনায় স্বাচ্ছন্দ্য এবং অদম্য বিচরণ করা সৃষ্টির এই মহানায়ক দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়েছেন বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়ে। প্রেম-ভালবাসায় সমর্থিত হয়ে প্রকৃতি ঈশ্বর আর প্রিয়জনকে এক সুতায় বেঁধে মহিমান্বিত হয়েছেন শৈল্পিক দ্যোতনায়। ঠাকুর বাড়ির ঐশ্বর্যিক পরিবারে জন্ম নেয়াই শুধু নয়, ইউরোপীয় সভ্যতার নবজাগৃৃতির সুবর্ণ ক্ষণে নিজেকে তৈরি করেন এক অভাবনীয় জীবনবোধে।
প্রচলিত সমাজ সংস্কারে নিজেকে উজাড় করে দিয়েও আধুনিকতা ও সময়ের নির্মাল্যে কি মাত্রায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন সেও যেন এক মুগ্ধতার বিস্ময়। আর বিশ্বজনীনতার অপার সমারোহে আপন সৃষ্টি বলয়কে উৎসর্গই শুধু নয় সর্বমানুষের মিলিত জয়ধ্বনিতে নিজেকে পূর্ণ করা সেটাই বিশ্বকবির অপরিমেয় লীলা বৈচিত্র্য। সৃজনসৌধের নানা মাত্রিক বৈশিষ্ট্যে রাবিন্দ্রিক চেতনায় যে অপার রূপ সুষমা, তা দীর্ঘ জীবনের এক সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খল পালাক্রম। ঠাকুর বাড়ির সমৃদ্ধ পরিম-লে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ নিজেকে তৈরি করেছেন অন্য সাধারণ দশজনের মতো। পর্বতপ্রমাণ প্রতিভা আর অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায় তার সর্বব্যাপী বিচরণ সেখানে সূর্যের দীপ্ত কিরণের মতোই জ্বলে উঠতেন আপন খেয়ালে। বুঝিয়ে দিতে পারতেন অতি সাধারণের মধ্যে অনন্যসাধারণ এক সহজাত প্রজ্ঞা, যা খুব সহজেই আলাদা মাত্রায় উদ্ভাসিত হতে সময় নিত না।
সৃষ্টিযজ্ঞের এক অপ্রতিদ্ব›দ্বী নায়ক রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব প্রকৃতির অপার সুষমায় মুগ্ধ, বিস্মিত। এক অদৃশ্য নিয়ন্তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতিতে নিজের আন্তরিক আকুতি নিবেদন করার শৈল্পিক দ্যোতনার মহা উৎসব তো বটেই। তবে সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিনায় কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাকাতর এবং শোকাবহ মৃত্যুকে নিয়ে কবির যে বহুমাত্রিক অনুভব আর আকুতি সেটাও যখন নিজের উপলব্ধিতে এলো, তাকে কিভাবে বরণ করলেন তাও আমাদের ভাবিত করে। ভেতরের আকুতি আর চিরবিদায়ের মর্মবেদনায় কতখানি উদ্বিগ্ন হন সেটাও এক অনন্য বিস্ময় এবং শান্তির আহŸান। সে কারণেই কি একটি গান রচনা করেন মৃত্যুর পরে গাওয়ার জন্য? যা চির প্রস্থানের আগে কাউকে জানতেও দেননি। বলে যান মৃত্যুর পরেই যেন সেই সঙ্গীতের আবাহন হয়।
‘সম্মুখে শান্তি পারাপার’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলও কবিগুরুকে শেষ প্রণতি জানান ২২ শ্রাবণ একটি শোকাবহ গানের মধ্য দিয়ে…
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে জাগায়ো না জাগায়ো না
সারা জীবন ধরে যে আলো দিল
তার ঘুম ভাঙায়ো না।