বিভুরঞ্জন সরকার :
কিছুদিন পরপর আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী হিসেবে পরিচিত কারও কারও নাম আলোচনায় আসে। বিভিন্ন মহলে নিন্দা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের ছবি ভাইরাল হয়। তারপর তাঁকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা আসে। দলের পক্ষ থেকে এমন সাফাই বক্তব্য দেওয়া হয়, যা পড়ে বা শুনে মনে হয়—দেশের প্রাচীন এই দলের নেতারা এতই সুবোধ বালক যে, তাঁদের হাতের মুঠিতে কলকি রেখে দুষ্ট লোকেরা তামাক টেনে গেলেও তাঁরা টেরটি পান না। অন্যদের নাকে যখন তামাকের গন্ধ যায়, তখন তাঁরা বোকার হাসি হেসে বলেন, ‘ক্যামনে এইটা হইলো, টেরও পাইলাম না!’
আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘সরলতা’র সর্বশেষ উদাহরণ হেলেনা জাহাঙ্গীর-কাণ্ড। এই কর্মতৎপর নারী আওয়ামী লীগের ‘সহজ-সরল’ নেতাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সংগঠনের একটি জেলা কমিটির উপদেষ্টা এবং একটি সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় উপকমিটির পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? দলের কেউ না কেউ তো তাঁকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, মদদ দিয়েছেন? আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করে হেলেনা জাহাঙ্গীর তার সভাপতি বনে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই খবর ভাইরাল হলো। এবং এ নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর আওয়ামী মহলে টনক নড়ল। গত প্রায় তিন বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের পরিচয় দিয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজ চালিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের এত সব ভারী ভারী নেতার কারও মনে তাঁকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন না জাগার বিষয়টি বিস্ময়কর, রহস্যজনক। অথচ ২০১৯ সালেই তাঁকে নিয়ে, তাঁর উত্থান ও ক্ষমতা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কাউকে দলের পদ-পদবি দেওয়ার আগে তার সম্পর্কে যে কোনো খোঁজ-খবর নেয় না—এটা কিন্তু কোনোভাবেই দলটির শক্তির দিক নয়, বরং দুর্বলতার প্রকাশ।
হেলেনা সম্পর্কে এখন যা জানা যাচ্ছে, তা হলো তিনি একজন স্থায়ী সরকারি দলের লোক। তাঁর দলের নাম এজিপি—অর্থাৎ, অলওয়েজ গভর্নমেন্ট পার্টি। তিনি দল বদল করেন না। সরকার বদল হলে তাঁর তো কিছু করার নেই। সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সম্ভবত এরশাদের হাত ধরেই অন্য আরও অনেকের মতো হেলেনারও উত্থান-পর্বের শুরু। এরশাদের পতনের পর তিনি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানেরও ঘনিষ্ঠ হতে সময় নেননি। তিনি মহিলা দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সিনিয়র সহসভানেত্রীর পদও পেয়েছিলেন। জামায়াতের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্কের কথাও বাজারে চালু আছে। এমন একজন হাসিমুখের নারী কি বেশি দিন সরকারি ছায়ার বাইরে থাকতে পারে?
হেলেনা আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েন। বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। এমন সৈনিকের সংখ্যা দলে বেশি, না কম—তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু এদের দিয়ে যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে না—এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। হেলেনা জাহাঙ্গীর নাকি এখন বিপুল টাকা-পয়সার মালিক। তিনটি তৈরি পোশাক কারখানা আছে তাঁর। ঢাকা শহরে নাকি বেশ কয়েকটি বাড়ি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াতেও বাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কীভাবে এবং কবে কবে তিনি এত সম্পদের মালকিন হলেন, তা কি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদন্তের আওতায় আসতে পারে না?
হেলেনা সরকারি অনুমতি না নিয়েই জয়যাত্রা টেলিভিশন নামে টিভি চ্যানেল চালু করেছেন কয়েক বছর আগে। এই চ্যানেলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক জড়িত আছেন বলেও তিনি দাবি করতেন। তিনি নিজেকে একজন সিআইপি বলে দাবি করেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়েরও তিনি পরিচালক পদে আছেন বা ছিলেন। তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি টিভি উপস্থাপক, লেখক এবং সাংবাদিকও। ২০১৭ সালে তিনি তথ্য অধিদপ্তর থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডও পেয়েছিলেন। কী করে সম্ভব হলো? এই কার্ড দেওয়ার আগে তো গোয়েন্দা প্রতিবেদন লাগে। নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রী বা নেতার সুপারিশে গোয়েন্দা বাধা দূর হয়েছিল।
আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ গঠন করতে গিয়ে তাঁর পা ফসকে গেল। আহা, বেচারা। আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হারিয়েছেন ‘ব্যবসায়ী’ হেলেনা জাহাঙ্গীর। গত রোববার আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও উপকমিটির সদস্যসচিব মেহের আফরোজ চুমকি স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তাঁকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। এর আগে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয় তাঁকে। ফলে এখন ক্ষমতাসীন দলটির সঙ্গে তাঁর আর কোনো সম্পর্ক নেই বলে ধরে নেওয়া যায়।
জয়যাত্রা টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হয়েছিলেন গত ১৭ জানুয়ারি। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের দিকে তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। আবদুল মতিন খসরু মারা গেলে ওই আসনে মনোনয়নের জন্য দলীয় ফরম নেন। তবে মনোনয়ন পাননি।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে কোনো মনগড়া বা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংগঠনকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং বিভিন্ন উপকমিটি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে যেকোনো নামের সঙ্গে ‘লীগ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দল ক্ষমতায় থাকলে নানান সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং বসন্তের কোকিলরা এ ধরনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়, যুক্ত হয় নানা আগাছা-পরগাছা।’
দলীয় সভাপতির ঘোষণা অনুযায়ী, দলের মধ্যে কারও প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে ব্যক্তি-স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো বিতর্কিত ব্যক্তির দলে অনুপ্রবেশ ঘটলে কিংবা কারও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে।’
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনেকটা বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো। ছাই দিয়ে মাছ ঢাকার প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগকে বেরিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ একটি পোড় খাওয়া সংগ্রামী রাজনৈতিক দল। এটা কোনো ব্যবসায়ী সংগঠন নয়। অথচ সংসদে ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী এবং সরকারের মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও এখন আর সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্ভবত নেই। তাই সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী এবং বসন্তের কোকিলদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগে কোনো অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। দু–একজনকে মাঝেমধ্যে বলির পাঁঠা বানিয়ে লাভ নেই। দুর্বৃত্ত ও সুবিধাবাদীদের পৃষ্ঠপোষক ও নেপথ্য শক্তিধরদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে না পারলে কাজের কাজ কিছু হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা