প্রতি বছরই দেশে আত্মহত্যার বহু ঘটনা ঘটে। তবে করোনা-পর্বে সেই সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। মান অভিমান, সংসারের জটিলতা, বাবা-মা-ভাইবোনদের সাথে ঝগড়া, প্রেমে বিরহ, আর্থিক সংকট ইত্যাদি কারণই মূলত আত্মহত্যার পেছনের কারণ। করোনাকালীন গত ১ বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। এসময়ে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ২২৮টি অর্থাৎ মোট আত্মহত্যাকারীর ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ৬ হাজার ২০৮টি, অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ।
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে দেশের আত্মহত্যার এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে ‘আগামীর বাংলাদেশ’ নামে অন্য এক সংগঠন জানিয়েছে, করোনা মহামারিতে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে ১১ জন।
এদিকে চট্টগ্রামেও প্রতিদিনই ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। গত ১০ দিনে চট্টগ্রাম নগরীতে অন্তত ৬টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ সংগঠনটির ভাষ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২২টি আত্মহত্যার ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন তারা।
অনলাইনে আয়োজিত ওয়েবনিয়ারে সংগঠনটি জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের হিসেবে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। অথচ ২০২০ সালে আত্মহত্যা করার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।
ওয়েবনিয়ারে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংগঠনটির জরিপ টিমের প্রধান এএসএম শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানান, দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। তখন ঘরবন্দী থাকাকালেই মূলত হতাশার শুরু। গত এক বছরের একটা দীর্ঘ সময় মানুষ গৃহবন্দি থেকেছে। এ সময় মানুষের মধ্যে নানা কারণে হতাশা ও বিষণ্নতা বেড়েছে। যার নানামুখী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। ব্যবসায় এসেছে মন্দাভাব। কেউ হারিয়েছেন চাকরি। সবমিলিয়ে করোনাকালে তুলনামূলক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে অস্বাভাবিক হারে।
আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী হচ্ছেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা, ৫ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ নারী-পুরুষ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ।
এদিকে করোনা মহামারির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মাঝে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে ১১ জন। চলতি বছরের বুধবার (১৩ জানুয়ারি) আগামীর বাংলাদেশ আয়োজিত ‘করোনকালীন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা : কারণ, প্রতিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা জানিয়েছেন আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য রিস্ক এসেসমেন্ট এবং রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নির্ধারণ করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, বিশেষত কোন্ বয়সের শিক্ষার্থীরা ভালনারেবল বা সুরক্ষিত নয় সেটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত দেশের মতো প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন সমাজবিজ্ঞানী, একজন মনোবিজ্ঞানী, একজন কাউন্সেলর ও থেরাপিস্ট থাকা দরকার।
এদিকে চট্টগ্রামে প্রতিদিনই ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। গত ৮ মে নগরীর বাকলিয়া থানার রাত্তারপুল এলাকায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জান্নাতুল ফৈরদৌস (২৮) নামে এক গৃহবধূ। ঘটনার পর থেকে তার স্বামী ইমতিয়াজ শাকিল পলাতক। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে স্বামীর সাথে অভিমান করে এই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন।
গত ৬ মে বাকলিয়া থানার মাস্টারপোল বউ বাজার এলাকায় সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন দেলোয়ার হোসেন। পেশায় তিনি একজন দর্জি। কী কারণে দেলোয়ার আত্মহত্যা করেছেন— এটি তার পরিবারের কাছেও অজানা।
ঈদে পছন্দের জামা না পেয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারার বটতলী ইউনিয়নের চাঁপাতলী গ্রামে সায়মা আকতার (১৫) নামের এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে গত ৩ মে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সায়মার মা রাবেয়া খাতুন পাড়া-মহল্লায় ফেরি করে নতুন কাপড় বিক্রি করেন। তার মধ্যে একটি জামা সায়মার পছন্দ হলে ঈদের জন্য মায়ের কাছে জামাটি আবদার করে ওই কিশোরী। কিন্তু তার মা জামাটি দিতে অপারগতা জানালে সায়মা নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
একইদিন চট্টগ্রামের মিরসরাই বারইয়ারহাট পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার জেরে এক প্রবাসীর স্ত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। নিহত খালেদা আক্তার মুক্তা (৩০) উপজেলার ধুম ইউনিয়নের বাসিন্দা কুয়েত প্রবাসী শরীফুল ইসলামের স্ত্রী। নিহত খালেদা আক্তার মুক্তা এক শিশু সন্তানকে (৫) নিয়ে বারইয়ারহাট পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে অন্তরঙ্গ ভবনের চতুর্থ তলায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আগের রাতে খালেদা আক্তার মুক্তার ঝগড়া হয় বলে জানা গেছে।
গত ১ মে মিরসরাইয়ে মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে রাফিয়া সুলতানা চাঁদনি (১৪) নামে এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। উপজেলার ধুম ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের শুক্কুর বাইজ্জার হাট এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। চাঁদনি ওই গ্রামের মোজাম্মেল হক প্রকাশ মহরম আলীর মেয়ে এবং স্থানীয় পাঞ্জুবের নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। জানা গেছে, চাঁদনীকে তার এক সহপাঠীর প্রেমের বিষয়ে ওই ছাত্রীর মা জিজ্ঞেস করে। এতে চাঁদনী হ্যাঁ বলায় বান্ধবীর সাথে চাঁদনীর ঝগড়া হয়। পরবর্তীতে চাঁদনীকে বান্ধবীর প্রেমের বিষয়ে সাক্ষী দেওয়ায় বকাঝকা করে তার মা। এতে অভিমান করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে চাঁদনী।
গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের আনোয়ারার চাতরী ইউনিয়নের রুদুরা গ্রামের বড়ুয়াপাড়ায় অরুণ বড়ুয়া (৫০) নামের এক কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করেন। মহাজন ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার ঋণ পরিশোধ করতে না পেরেই তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে জানা গেছে।
গত ১৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন কাপাসগোলা এলাকায় প্রদীপ ঘোষ বাবলা (৫২) নামে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, করোনাকালে চাকরি চলে যায় প্রদীপের। ফলে দীর্ঘ এ সময় সংসারে টানাপড়েন চলছিল। এরই মধ্যে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন তিনি। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি ও স্ত্রীর সাথে মলোমালিন্যও হচ্ছিল। এসব নিয়ে তিনি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এসব কারণে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতেন পারে বলে পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন।
গত ৫ মার্চ সুইসাইড নোট লিখে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। নাইমুল হাসান নামের ওই শিক্ষার্থী খাগড়াছড়ির রামগড়ে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন।
হঠাৎ করে আত্মহত্যার কেন এই প্রবণতা— এমন প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা তিনি বলেন, ‘করোনাকালে মানুষ কঠিন একটা স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জীবন-জীবিকা, নিজের অস্তিত্বের লড়াই করতে হচ্ছে সবসময় একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। নানা বিষণ্নতা তাকে চেপে ধরছে। দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ থেকে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। তাই আত্মহত্যার কারণগুলো যত তুচ্ছই হোক না কেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছে তা অনেক বড় হয়ে উঠছে।’