নার্স দিয়ে কলেজছাত্রীর গর্ভপাত: মৃত্যুর পর করোনার গুজব

0

বিশেষ প্রতিনিধি।    |

করোনা মহামারিতে প্রায় নিস্তব্ধ বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশ। সেই নিস্তব্ধতা গিলে খেয়েছিল এক স্বপ্নবাজ কলেজ ছাত্রীর আত্মচিৎকার।

নগরের সিটি হেলথ ক্লিনিকে হাতুড়ে নার্স দিয়ে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয় কলেজ ছাত্রী রিফাত সুলতানাকে (২৫)। একটি সম্ভাবনাকে হত্যার পর ছড়ানো হয় করোনার গুজব। যে কারণে মেয়ে নিহতের শোক ভোলার আগেই লাশ দাফনে চরম বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয় নিহত রিফাতের পরিবারকে।

রিফাতের মৃত্যুর প্রায় ছয়মাস পর বুধবার (১১ নভেম্বর) চট্টগ্রাম নগরের সিটি হেলথ ক্লিনিকের ওই হাতুড়ে নার্স, হাসপাতালের পরিচালকসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে একজন ইতোমধ্যে অবৈধভাবে গর্ভপাত করানোর সময় তার মৃত্যু হয়েছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

গ্রেফতাররা হলেন, হাসপাতালের পরিচালক মো. হারুনর রশিদ (৬০), কথিত নার্স অলকা পাল (৩২), আয়া গীতা দাস (৪৫) ও নার্স সাবিনা ইয়াসমিন চম্পা (৪৩)। এর আগে ঘটনার পরপরই গ্রেফতার করা হয়েছিল রিফাতের কথিত বন্ধু জিসানকে।

এদিকে আসামিদের গ্রেফতারের পর নগরীর চকবাজার এলাকার অবস্থিত সিটি হেলথ্ ক্লিনিকটি আদালতের নির্দেশে বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) দক্ষিণের ডিসি মেহেদী হাসান জানান, চকবাজারের সিটি হেলথ্ ক্লিনিকের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। হাসপাতালের কথিত পরিচালক হারুনর রশিদ কয়েকজন হাতুড়ে আয়া ও নার্স দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা করছিলেন।

গত ১৫ মে কলেজছাত্রী রিফাতের অবৈধভাবে গর্ভপাত ঘটানোর চেষ্টা করে আসামিরা। এ সময় হাতুড়ে নার্সের সাহায্যে রিফাতের গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু হাসপাতালের পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে নিহতের পরিবারকে করোনায় রিফাতের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়। অভিযুক্ত জিসান এই গুজব ছড়িয়ে দেয় রিফাতের গ্রামের বাড়িতেও। যার কারণে অপচিকিৎসায় মৃত্যু হলেও রিফাতকে দাফনে বেগ পেতে হয় তার পরিবারকে।

ডিসি মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে ওই কলেজ ছাত্রীর মৃত্যু হয়। গত চারমাস ধরে আমরা মূল রহস্যটি উৎঘাটন করেছি। ঘটনাটি এমন, গত মে মাসের ১৪ তারিখে রিফাতকে ওই হাসপাতালে নিয়ে আসে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য। এই ধরনের সেবা যে ধরনের চিকিৎসক দিয়ে করানো প্রয়োজন, আমরা তদন্তে পেয়েছি সেই ধরনের কোনো চিকিৎসক বা নার্স সেখানে নেই। এই চিকিৎসা করেছে দুইজন নার্স ও একজন আয়া যাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, যারা দেখে দেখে এসব শিখেছে ওই হাসপাতালে। এই অপচিকিৎসার কারণে মেয়েটির মৃত্যু ঘটে।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হলো, এই হাসপাতালের পরিচালক নিহতের অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে বলে আপনার মেয়ের করোনা হয়েছিল এবং করোনার কারণে তিনি মারা গেছেন। অভিভাবক প্রথমে বিভ্রান্ত ছিলেন, পরবর্তিতে তারা জানতে পারেন গর্ভপাত করতে গিয়ে তাদের মেয়ে মারা গেছে তখন তারা হত্যা মামলা দায়ের করেন।’

আসামিদের স্বীকারোক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অপচিকিৎসা করানোর সময় কথিত নার্সরা যখন বারবার ডাক্তার ডাকার অনুরোধ করলেও তিনি সেটি করেননি। বিষয়টি অবহেলার নয়, সবমিলিয়ে এটিকে আমাদের কাছে হত্যাকাণ্ড বলে বিবেচিত হয়েছে।’

পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় নিহতের কথিত বন্ধু জিসানসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ঘটনার পর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও নার্স অলকা পাল।

নিহতের বাবা ঠিকাদার খোকন মিয়াজি জানান, নিহত রিফাত সুলতানা ও তার ছোট বোন রিয়াদ সুলতানা নগরের চাঁন্দগাও আবাসিকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। ওই সময় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দুজনেই রাঙ্গুনিয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। ১৩ মে রিফাত সুলতানা নিজের কম্পিউটার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য শহরে আসে। ১৫ তারিখ তিনি রিফাতের মৃত্যু সংবাদ পান।

খোকন মিয়াজি বলেন, “আমি সেদিন দোহাজারি ছিলাম। হটাৎ করে একজন ফোন দিয়ে বলল ‘আপনার মেয়ে মারা গেছে’। আমি জিজ্ঞেস করলাম তুমি কে। বললো ‘আমি জিসান’। জানতে চাইলাম কোথায় আছে আমার মেয়ে। সে বলল, ‘চকবাজার সিটি হেলথ্ ক্লিনিকে’। আমার বিশ্বাষ হচ্ছিল না, সুস্থ একটা মেয়ে বাড়ি থেকে গেছে কম্পিউটারের জন্য। হটাৎ করে সে কিভাবে মারা গেছে?’

তিনি বলেন, ‘আমি মেয়ের মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে মারা গেছে। তারা বললো করোনা…করোনা…। আমার মেয়েটাকে আমাকে ধরতেও দেয়নি। রমজান মাসে এমন একটা ঘটনা ঘটল, আমাকে আমার মেয়েকে দাফন করতেও অনেক কষ্ট হয়েছে। তাকে ধোয়ানোর জন্যও কাওকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষে ধোয়াতে গিয়ে আমরা দেখলাম মেয়ের শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পট আছে। বুঝতে পারলাম আমার মেয়ে করোনায় মরেনি।’

নিহতের বোন রিয়াদ সুলতানা বলেন, “১৪ তারিখ আপু আমাকে ফোন দিয়ে বলে ‘আমি অসুস্থ’। পরেরদিন আমাকে বলে আমি সকালে আসব কিন্তু এরপর থেকে আমি ফোন দেই কিন্তু রিসিভ হয় না। বিকেলে আমাকে একজন ফোন দিয়ে বলে লাশ নিয়ে যাও। ওরা আমার আপুর নাম্বার থেকেও ফোন দিয়েছে। সিজানের নাম্বার থেকেও ফোন দিয়েছে। বলে ‘তোমার বোন করোনায় মারা গেছে’।”

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রহুল আমিন বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পরপরই আমরা মে মাসেই অভিযুক্ত জিসানকে গ্রেফতার করি। পরে অনেক কষ্টে নিহতের লাশ পরিবহনকারী গাড়িচালককে শনাক্ত করতে সমর্থ হই। গতকাল হাসপাতালের পরিচালকসহ বাকি চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযুক্ত ক্লিনিকটি অবৈধভাবে চলছিল।

Share.

Leave A Reply