সাদিয়া তাজিন *
ধ্রুব বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ জীবনবীমা কর্পোরেশন অফিসে একাউন্টস অফিসার।বাবা রহমতউল্লাহ চৌধুরী রেলের ফোরম্যান। বাবার কর্মসূত্রে তারা যেখানে থাকে সেটাকে বলা হয় রেলওয়ে কলোনী। আসাম বেঙ্গল রেল ও ইস্ট বেঙ্গল এ দুটোকে একই প্রশাসনের আওতায় এনে চট্টগ্রামে রেল প্রশাসনকেন্দ্র স্থাপন করে ব্রিটিশরা এ রেল চলাচল ব্যবস্থা চালু করেছিল।তারা দেশের অভ্যন্তর হতে কাঁচামাল সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়ে যেত আবার তাদের তৈরিপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হতো।এ আন্ত:ও বহি:বাণিজ্যে রেল ছিল প্রধান সহায়। পাকিস্তানের শাসককূলও ব্রিটিশদের অনুরূপ পথ অনুসরণ করে।রেলওয়ের হেড কোয়র্টারগুলো চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার থেকে কৈবল্যধাম পর্যন্ত ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়ায় সুরম্য বাংলোয় তৈরি করা হয়। এমনকি মূল্যবান কাঠের অপূর্ব নির্মাণশৈলী দিয়ে এ সকল বাংলো ও বাসাবাড়ি নির্মিত হয়েছিল।কোয়ার্টারের রাস্তাগুলোর দুপাশে লাইটপোস্ট ছিল ও রেনট্রি, গর্জন ও বিভিন্ন গাছে রাস্তাগুলো সুশোভিত করে রাখে।ধ্রুব ছোটবেলায় এসব বাংলোগুলোতে বাবার হাত ধরে কত এসেছে, বাবা বড় বড় অফিসারদের সাথে দেখা করতে এলে সাথে করে তাকেও বেড়াতে নিয়ে যেত। তবে ধ্রুবরা যেখানে থাকে সেটাকে পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনী বলা হলেও সেটার ব্যবস্থাপনা অতটা সু্ন্দর নয়। ছোট একটি টিন শেডের চার রুমের বাসায় ধ্রুব বাবা মায়ের সাথে থাকে।তবে ধ্রুব’র বাবার চাকরির মাইনে থেকে বাসা ভাড়া বাবদ যা কাটে তা খুব বেশি নয়। ধ্রুব যে কক্ষে থাকে তারপাশে একটি বড়সড় বকুল ফুলগাছ আছে। সবাই এটাকে বকুল তলা বলে।ফুলগুলো রাতে ফোটে সারাদিন ধরে টুপটাপ ঝরতে থাকে। ভারি সুগন্ধে সব সময় ধ্রুবর’র রুমটা মাতিয়ে রাখে।কলোনীর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুল কুড়াতে আসে। মাঝে মাঝে তারা গায়-
‘‘ বকুল ফুল বকুল ফুল/ সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি/
শালুক ফুলের লাজ নাই/ রাইতে শালুক ফুটে/
যার সনে যার ভালোবাসা/ সেইতো মজা লুটে।
গানটির ফোক ফিউশন তাদের কন্ঠে বেশ ভালোই লাগে। গানটি অনেক মেলোডিয়াস লাগে ধ্রুব’র। সকালে রুমের পূর্ব দিকটার এই জানালা খুললেই গাছের ফাঁকে প্রথম হাওয়া আর রোদ সোনালি পাখি হয়ে বাতায়ন পাশে ওড়ে আসে সে কক্ষটিতে। আলোয় ভরা কক্ষটি থেকে আবার তাড়াতাড়ি ওড়ে চলে যায় রোদটুকু। ধ্রুবদের পাশের বাড়িতে থাকেন ফুলেশ্বরী আপুরা।ফুলেশ্বরীর বাবা মিনহাজ সাহেবও রেলওয়ে চাকুরজীবী।ফুলেশ্বরী তাদের একমাত্র মেয়ে। লেখাপড়ায় দারুণ মেধাবী ফুলেশ্বরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স, মাস্টার্সে কেমিস্ট্রির ফার্স্ট ক্লাশ পাওয়া ছাত্রী।ভালো ছাত্রী বলে কলোনীর সকলের তার প্রতি একটা ভালোবাসার অপার স্পন্দন অনুভূত হয়। পরে কেমিস্ট্রি থেকে এমফিল সম্পন্ন করে পিএইচডি করেছিলো। এরপর আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ এর সুযোগ পায়। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। সেখানে বাংলাদেশি একটি ছেলের সাথে ফুলেশ্বরী আপুর বিয়ে হয়। ধ্রুবর জ্ঞান হবার পর থেকে অদূরে সামনা সামনি দুটো জানালা দিয়ে দেখত,ফুলেশ্বরী আপু হুমায়ুন পড়তে খুব ভালোবাসতো।প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে ২/৩ টি বই কিনে আনতো। আনন্দে আপ্লুত হয়ে ধ্রুবকে জানালা দিয়ে ইশারায় ডেকে দেখাতো।নিজের কষ্টার্জিত টিউশানির টাকা দিয়ে প্রতিমাসে বই কিনে ফুলেশ্বরী আপুর অনুভূতিটা দেখলেই ধ্রুব’র চোখের পাতা যেন ভিজে আসতো। ধ্রুব কিছু বলবার আগেই আপু বলে দিতো, জীবনে, সমাজে ধ্বংস ও ধসের সামনে একটি ভালো বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।একটি ভালো বই যে কোনো মানুষের সুন্দর চিন্তা ভাবনায় অবিচ্ছিন্ন করে রাখে। বই পড়ার প্রয়াস আপুকে অন্যরকম অনুভূতির জগতে টেনে নিতো। আপুর বইপড়া শেষ হলেই প্রতিটা বই ধ্রুবর পড়বার সুযোগ হতো। ফুলেশ্বরী আপুর প্রতি গভীর টান আজো রয়ে গেছে ধ্রুব’র। আপু নেই, তবু তাঁর রুমে আলমীরার তাকে তাকে বইগুলো সাজানো আছে। ধ্রুব সে রুমে গেলে, বই পড়লে ফুলেশ্বরী আপুর প্রাণের ছোঁয়া অনুভব করে। কথাশিল্পী হুমায়ুন সম্পর্কে একদিন বললো, জানিস ধ্রুব কাল নাকি হুমায়ন আহমেদকে বইমেলার স্টল থেকে পুলিশ বের করে দিয়েছে। কারণ, তিনি মেলায় থাকলে লোক সমাগম সামলাতে কর্তৃপক্ষের কষ্ট হয় বলে।আসলে হুমায়ুনের বইতে যে জীবনদর্শন,বিজ্ঞান, কাহিনী মিলে তা অন্য বইতে পাওয়া যায় না।তাই পাঠক তাঁকে মিস করবেনই বা কেন!আপুও বলছিলেন ,তাইতো তিনি থাকলে কোনো পাঠক তাঁকে না দেখে, অটোগ্রাফ না নিয়ে গেলেইতো তাদের অন্তরে একটা বড় অতৃপ্তির ব্যঞ্জনা রয়ে যাবে। স্কুলে কোনো অনুষ্ঠানের আগে ফুলেশ্বরী আপু শিখিয়ে দিতেন কবিতা আবৃত্তিটা করতে হবে,নির্বাচন করে দিতো গল্প বলা। দেখা যেত ধ্রুব প্রথম পুরষ্কারটি নিয়ে এসেছে।ধ্রুবর আনন্দ দেখে খুব হাসতো ফুলেশ্বরী আপু। ধ্রুবদের অদূরে কলোনীর একটি পরিত্যক্ত বাসা আছে। যেটাতে কেউ থাকে না।বাসার ছাদে ওঠবার জন্যে কাঠের সিঁড়ি আছে।দুপুরে সময় পেলে প্রায়ই সেখানে বসে ফুলেশ্বরী আপু গল্পের বই পড়তো। কলোনীর আরো একটি বাসা থেকে লম্বা চুলের বিনুনি দুলিয়ে আসত সুপ্রিয়া আপু। তারা বেইসমেট। দুজনে শাটলে করে ভার্সিটি আসা যাওয়া করে।সে কাঠের সিঁড়িতে বসে কখনও বা ছাদের ওপর দুই বান্ধবী মিলে আচার খেতে খেতে ভালই গল্প জমাতো। ঠিক তখন সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলতো ধ্রুব ও তার সমবয়সীরা। ধ্রুব ছিল অধিনায়ক। ভালো ক্রিকেটার। বিশেষত ভালো স্পিনিং বল করতে তার জুড়ি নেই। মূলত ধ্রুব সেই স্কুল , কলেজ, ভার্সিটি লাইফে ক্রিকেটে বোলিং, ফিল্ডিং সব দিক থেকে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
ফুলেশ্বরী যখন আমেরিকা চলে যাচ্ছে ধ্রুবকে সেদিনও অনেক উপদেশ দিয়েছে। মন দিয়ে যেন লেখাপড়া করে, অনর্থক টাইম পাস না করে, তার বইগুলোর যেন একটু যত্ন করে।ইচ্ছে করলে যেন বইগুলো পড়ে, মাঝে মাঝে একটু রোদ লাগায়। ফুলেশ্বরী চলে যাওয়ার পর খালাম্মা, খালু সবসময় ধ্রুবকে বলতেন, মাঝে মাঝে রুমটা যেন সে ব্যবহার করে।
ফুলেশ্বরী যাবার পর ধ্রুব যেন খুব একা হয়ে যায়।ধ্রুব একজন কথা শেয়ার করার ভালো সঙ্গী হারাল।ধ্রুব’র ভুল ত্রুটি শোধরিয়ে দেয়ার আর কেউ রইল না। স্নেহ ভালোবাসার মতো মানুষ যেন আর পায় না। অনেক স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ে ধ্রুব।অনেক স্মৃতি কখনই ফ্যাকাশে হয় না। ফুলেশ্বরী আপুর সাথে ধ্রুব’র টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো তেমনি। স্মৃতিগুলো যেন মধ্যাকাশের জ্বলজ্বলে সূর্যের মতো প্রখর। ধ্রুব মনে মনে বলে, ফুলেশ্বরী আপু তোমাকে কোনদিন ভুলিনি, ভুলবো না।
ফুলেশ্বরী আমেরিকা যাওয়ার প্রায় মাসচারেক পর প্রথম ও বাসায় যায় ধ্রুব। উদ্দেশ্য-ফুলেশ্বরীর কিছু বই এনে বাসায় পড়বে। ধ্রুব বেল বাজাতেই দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো একটি সুন্দর মুখ।ধ্রুবর মতো মেয়েটিরও দুচোখে যেন অপার বিস্ময়।হঠাৎ ধ্রুবর বুকের ভেতর তিরতিরে একটা ভালোলাগার কম্পন ডালপালা মেলে ওঠলো। প্রাণপনে সেটাকে রুখতে চাইল। তার আগেই মেয়েটি বলে ওঠলো , আমি ফুলেশ্বরীর খালাতবোন প্রিয়নন্দিনী।আপনি কাকে চান?প্রিয়নন্দিনী যে স্বরে নামিয়ে কথা বলে ওঠলো তার জন্য ওপর ধ্রুবর মনটা অনেক বেশি নরম হয়ে ওঠে প্রিয়নন্দিনীর ওপর।হঠাৎ করে খালাম্মা এসে পড়ল।ধ্রুব যেন সংকোচে কুঁকড়ে গেল। কিছু বলতেই যেন জিভ জড়িয়ে আসছিলো তবু খালাম্মাকে উদ্দেশ্য একটা সালাম দিল। খালাম্মা ধ্রুবর পিঠে হাত বুলিয়ে ভেতরে ঢোকালেন।খালাম্মার মাধ্যমে প্রিয়নন্দিনীর সাথে ধ্রুব আবারো দ্বিতীয়বার পরিচিত হলো।
ধ্রুব পাহাড়তলী রেল ইস্টিশনের রেললাইনগুলোর পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।মনে পড়ল পকেটে ঠিকানাবিহীন একটা চিঠি আছে।একদম বেরুনোর সময় অফিসের পিয়ন হাতে দিয়ে বলেছিল,একজন মহিলা এসেছিলেন ধ্রুব’র খোঁজে। ধ্রুব তখন বীমার একজন ক্লায়েন্ট নিয়ে অফিসের অন্যফ্লোরে গিয়েছিল। চিঠিটা হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে হোঁচট খেতে খেতে বাস স্টপেজের দিকে দৌঁড় দেয়। এমনিতেই তো রাস্তার অবস্থা খানা-খন্দ আবর্জনায় ভরা।রাস্তার মাঝখানে ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। চারদিকে ধুলোর ঝড়। কোথাও কোথাও ওয়াসার লাইনের পাইপ ফেটে পানির বারোটা বাজছে। তার ওপর অফিস ছুটির সময়ে বাসঅলা, সিএনজি অলা, টেম্পুঅলা, রিক্সাঅলা, প্রাইভেট গাড়ীগুলোর দাপট।বাঙালি জাতি তো সহনশীল ভোটদাতা। তাদেরকে সবকিছু সহ্য করানো শিখানো হয়।কিন্ত্ত বিদেশীদের বিচারে এদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের উচ্চতায় পৌঁছাতে যাচ্ছে। ধ্রুব দেখতে পায় কয়েকটা ৬ নম্বর বাস আসছে, ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর লুটোপুটি খাচ্ছে। এভাবেই একটি বাসে প্রতিদিনের মতো ব্যঙ্গচিত্রের ন্যায় রেলিং ঝুলে আসতে আসতে বাসের ভেতর ঘর্মাক্ত কলেবরে আর চিঠির কথা মনে ছিলো না। তাই চিঠির কথা যতক্ষণে মনে ওঠলো, ততক্ষণে বাসার কাছাকাছি এসে যায়। বাসায় এসে শাওয়ার সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চিঠিটা খাম থেকে বের করে। লেখা দেখে নিমিষেই চিনে ফেলল প্রেরকের নামও দেখে ফেলল। সবকিছু ঠিকঠাক,প্রিয়নন্দিনীই এসেছিল। তাকে না পেয়ে প্রিয়নন্দিনী লিখেছে
ধ্রুবতারা,
ভালোবাসা জেনো।
বলেছিলাম তোমায় চিঠি লিখব প্রতিদিন একটি করে। কই, সময় হয় না, শব্দহীন শব্দে রাত্রিরা কেঁপে ওঠে। হৃদয়ের তলদেশে কত দেনা জমা হয়ে গেছে।আজ যখন তুমি আমার অস্থিরতা ঠের পাবে, নিজেও অস্থির হবে, অমিমাংসিত ভালোবাসার সমীকরণ মেলাতে পারে না। তাই আমি আজ তোমার বন্ধনহীন সম্পর্কের মুখোমুখি।
মানুষ যখন খুব কষ্ট পায়, ভুলের অধিক বিশ্বাসে ঠকে, তার মনটা ক্ষুধার্ত শিশুর মতো আর্তনাদ করে। নিজস্ব নিঃশ্বাসগুলো বিষম কষ্টের ঘ্রাণে আক্রান্ত হয়। তুমি দূর থেকে বুঝবে না বন্ধু সে দুঃখের ঢেউগুলো কত বড় বড় সুনামির মতো আচড়ে পড়ে। বেদনার জীবানুরা ক্ষয়ে ক্ষয়ে দেয় হৃদপিণ্ড।
তুমি তো জান ,রাত হয় ভোর, ভোর আবার আলোর মুখোমুখি। আমিও বন্ধু দীর্ঘদিবস রাতের পর সে রকম আলোর মুখোমুখি হয়েছি। বাড়ি ফেরা চুপচাপ সূর্য হয় আমার প্রেম। রক্তাক্ত সন্ধ্যা হয় আমার ভালোবাসা।
আমার কষ্ট পাওয়া ভালোবাসার ছায়ারা মিলিত হয় মেঘ হয়ে। তারপর অবিশ্রান্ত শ্রাবণের আকাশ হয়। কেউ তা জানে না।জলের শরীর কতটা ব্যস্ত থাকে।
তুমি তো চিনবে না বন্ধু আমার অচেনা অসুখ। উদাস দুপুরের মতো বাড়ে।
অহর্নিশ আলো ছায়ার আজন্ম সংস্কারে আমি পুড়ি। যন্ত্রণাবোধ করি।
অনেক ফাল্গুন চলে গেলেও বৃক্ষের শাখায় ব্যথিত স্মৃতির যানজটে আমি আটকা পড়ি। স্মৃতিরও নিভৃতে বয়স বাড়ে।
আমার পরিচিত রোদ খুঁজি, স্বপ্নভরা প্রেমময় আলোর জীবন,শৈশবের ক্রিকেট মাঠ,স্বপ্নের ক্রিকেটার, ব্যাট, বল ,ক্রিজ, বর্ণিল ঘুড়ি, বকুল মালা,গল্পের বই, রোদ্দুর কিছু খুঁজে পায় না।
তোমার কষ্ট হয় না ধ্রুবতারা, আমার জন্য!
আমার চোখের ত্বকে কত ব্যর্থতা দেখবে না!
এসো!
ইতি
তোমার প্রিয়নন্দিনী
চিঠিখানি পড়ে জ্বালা, অনুশোচনা, ক্ষোভ ও অভিমানের অনুভূতি ঝরে পড়ার কথা। কিন্ত্ত নাহ্,
চিঠিখানি পড়তে পড়তে ধ্রুব’র দু’চোখের কোণ বেয়ে স্রোতের বেগে বারি বর্ষণ হতে থাকে অবিরত। ইচ্ছে করে তক্ষুনি ছুটে যায় প্রিয়নন্দিনীর কাছে। কোন গুরুভারে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।দুঃখ, বেদনাভারে ভারাক্রান্ত ধ্রুবর জীবন। সে এক বিশুদ্ধ বেদনা। মনে মনে বলে, প্রিয়নন্দিনী কথা রাখেনি। আজ তোমার পত্র আমার কাছে একরাশ অভিমান,, কখনও ভাঙ্গা মন,কিছুটা অজানা পিছুটান কখনও বা অননুমেয় ভালোবাসা। শিউলী তলায় কথা হয়েছিল, যদি বাড়ি থেকে ফিরতে না পার, তাহলে যে চারদেয়ালের খাঁচায় তুমি অন্যের শয্যাসাথী হবে, আমি তোমার কক্ষে, তোমার ঝুল বারান্দায় প্রতিরাতে মাকড়শা হয়ে যাব। জাল বুনব,তুমি শয্যা হতে ওঠে আমার কাছে আসবে।আমাদের ভালোবাসার সাক্ষাৎকার মিলবে। তুমি রোজ একটি করে চিঠি লিখে রাখবে, আমি সারারাত ভালোবাসার ব্যাকুলতায় সেটি পড়বো।আমি তো তোমার চিঠির প্রত্যাশি ছিলাম প্রতিরাত। কই তুমি একরাতও এসে তোমার ঝুলবারান্দায় দাঁড়াওনি। চিঠি লিখে রাখনি। আমি তো প্রতিরাতে আসতাম, খালি হাতে ফিরে যেতাম। আজ দশটি বছর পরে তোমার আমাকে চিঠি লেখার কথা মনে পড়লো?তুমি দেশে এসেছো জানতে পেরে তোমার বান্ধবী নদীকে দিয়ে যখন খোঁজ নিলাম, তারপর তুমি লিখলে আমায়?
কথা রাখোনি প্রিয়নন্দিনী, আমি বলেছিলাম,তোমার সাথে তোমার পরিবারের সরলপথের বহুমুখী জালে কখনও আটকা যাবে না। হয়ত ক্লান্ত হবে, তবু আবার দুজনে একই পথে হারাবো।তাই এমবিএ শেষ করার আগে থেকেই আমি যেন মরুর বালুতে সাঁতার কেটেছি একটা চাকরির জন্য। চাকরি হয়নি। আবার তোমায় ভালো ক্রিকেট ম্যাচ উপহার দেবো বলে ভর দুপুরের রোদে কতোটা ভিজেছি। ক্রিকেট টীম গড়েছি,খেলা প্র্যাকটিস করেছি।
অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা না থাকলে একজন পুরুষও কি মুক্তি পায়?তোমরা তো নারীমুক্তির কথা বলো। আসলে পুরুষেরও সব সম্পর্ক রাখতে গেলে, স্বপ্ন সাজাতে গেলে আর্থিক মুক্তির প্রয়োজন হয়। এই ক্ষমতায়ন ছাড়া সংসার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কতো কঠিন। যদি কঠিন না হতো, সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাটি তৈরি করে নিতে পারত, এমবিএ পাশের পর পরই প্রিয়নন্দিনীকে নিজ সিদ্ধান্তে বিয়ে করে নিতে পারতো ধ্রুব।
প্রিয়নন্দিনী ছিল ধ্রুব’র ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণার সব উৎস। অনেক ক্লান্তির ভেতরও ধ্রুবকে বলতো,আমায় পেতে হলে তুমি ক্রিজেই দাঁড়িয়ে থাকবে। গুগলির মত ল্যাং আসবে, তোমার জীবনে স্পিন বলের মতো আমি আসব বিশাল নীল আকাশের নিচ থেকে তোমায় সাথে নিতে। অজান্তেই বিড় বিড় করে ধ্রুব বলে খেলার মাঠটাও ফাঁকা।আজ, নীলাকাশখানি ফিকে। প্রিয়নন্দিনী তো আমার মনের ভেতর আকাশ হয়ে আছো। আমার স্বপ্ন, বিশ্বাস,কল্পনা সবই যে তুমিই ছিলে।ধ্রুবর কষ্ট, প্রিয়নন্দিনী তাকে যে অনুপ্রেরণা দিয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না। এক সময় ফুলেশ্বরীর বইয়ের আলমারীর মত ধ্রুব’র রুমের আলমীরাটাও খেলার বিভিন্ন ক্রেস্ট আর মেডেলে ভরে ওঠলো। খেলার পুরষ্কার স্বরূপ বাঁধাই করা সার্টিফিকেটগুলো দেখলে মনে হয় সবখানেই প্রিয়নন্দিনীর মুগ্ধ বিচরণ। প্রিয়নন্দিনীকে এসব পুরষ্কার থেকে কখনই আলাদাই করতে পারে না ধ্রুব। প্রিয়নন্দিনীর অনুপ্রেরণাই আজো ধ্রুবকে সবসময় একটা ঘোরের ওপর রাখে।
স্টেশনের বস্তির ছেলেরা, কলোনীর ছেলেরা সবাই মিলে যখন আকাশে ঘুড়ি ওড়াতো প্রিয়নন্দিনী বলতো , তোমাদের এখানে বড় বড় গাছগুলো ঘুড়ি ওড়ানোর ক্ষেত্রে বড় শত্রু। গাছের ফাঁকে, পাতার ফাঁকে একবার ঘুড়ি আটকালেই হয়। না খোলা যায়, না পেড়ে আনা যায়। অনেক উচুঁ আর বড়বড় গাছগুলো। সবগুলো ঘুড়ি গাছের পাতার ফাঁকে লেগে থাকে। আকাশে যখন বর্ণিল সব ঘুড়ি ওড়তো প্রিয়নন্দিনী আর ধ্রুব সবসময় লাল, সবুজ ঘুড়ির পক্ষে থাকতো। কোনো কোনো সময় লাল, সবুজ দুটো ঘুড়ি কিনে নিয়ে তাতে পারমানেন্ট কলম দিয়ে লাল ঘুড়িতে সবুজ রঙে প্রিয়নন্দিনী, সবুজ ঘুড়িতে লাল রঙে ধ্রুবতারা লিখে নাটাইসহ ধ্রুবর হাতে দিতো। ধ্রুব ও প্রিয়নন্দিনীর পাশে এসে ধ্রুবর বন্ধু অর্ণব প্রিয়নন্দিনীর হয়ে অন্য নাটাইটি নিতো। প্রিয়নন্দিনী বলতো, সবগুলো ঘুড়ি কেটে কেটে এই লাল সবুজ ঘুড়ি দুটোই আকাশের বুকে দূর্দান্ত -দুষ্ট, দূরন্ত-দূর্বার হয়ে ওড়ে ওড়ে স্বাধীনভাবে ওড়তে থাকবে। কারন ওরা সুখি জুটি, সারা আকাশে সুখেই লুটোপুটি খাবে। ধ্রুব ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে প্রিয়নন্দিনীকে গল্প শোনাত। সেই কবে চীন দেশে ঘুড়ির উৎপত্তি হয়েছে। আস্তে আস্তে এশিয়ার অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন শুরু হয়। এরপর ইউরোপে প্রচলন হয়। তবে প্রথম কাগজ বা হাল্কা তন্ত্ত জাতীয় সিল্কের কাপড় দিয়ে ওড়ানো হতো। প্রিয়নন্দিনী! আজ গল্প শোনার কেউ নেই আমার। কলোনীতে এখন ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয় না।সে কবে থেকে লাল, সবুজ কাটা ঘুড়ি দুটি গাছের ওপর ঝুলে আছে অসহায়ের মতো। বৃষ্টির ফোটায় ঝরে গেছে কাগুজে ঘুড়ির লাল কাগজগুলো, নষ্ট হয়ে গেছে,সবুজ রংগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে।কটা কাঁচা বাঁশের চিকন কঞ্চি যেন মনের ভিতর এত বছর কেটে যাচ্ছে ভালোবাসার জালক। প্রিয়নন্দিনী কেন কথা রাখলে না!
২
কলোনীর প্রতিটা বাড়িতে চারধারে লোহার কাঁটাতার দিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া। চারধার ফাঁকা এসব বাড়িতে প্রয়োজন ছাড়া ছোট্ট একটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে না কেউ। তবে বাড়ির সামনে সরাসরি সরু পিচের রাস্তা রয়েছে। সকাল থেকে ধ্রুব’র বয়সী একটা ছেলে কলোনিতে তরিতরকারি, লালশাক, সজনে ডাটা, কুমড়োশাক ইত্যাদি নানারকম শাকের আটি বেঁধে একটা ভ্যান গাড়িতে করে বিক্রি করে। সাথে কয়েক পদের মৌসুমী তরকারিও থাকে। সবার সাথে তার একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক। সকালে পরিচিত সব বাসায় চাহিদামতো শাকসব্জি দিয়ে যায়।বিক্রিত শাকসব্জির টাকা বিকেলে নিতে আসে। যদিও কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গেই দাম চুকিয়ে দেয়। প্রতিদিনের মতো আজো জহির এলো। এর পর পর এলো মাছঅলা, মুরগী অলা। ধ্রুব ফুলেশ্বরী আপুর মা’র পাশে থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়নন্দিনীকেও বাজার কিনতে দেখল। প্রিয়নন্দিনীর দু’হাতে বাইরে থেকে রাতে ঘরে না ঢুকানো কতকগুলো শুকনো কাপড়ের স্তূপ। বাজার যা কেনার, তা কিনে প্রিয়নন্দিনীও খালাম্মার সাথে বাসায় চলে গেল। ধ্রুব যেন অনিমেষ তার দরজায় দাঁড়িয়ে অপলক যেন তাকিয়ে থাকে প্রিয়নন্দিনীর নুপুর পরা পা জোড়ার দিকে।যে ধ্রুব ভার্সিটি অবধি কোনো মেয়ের প্রতি কখনই আগ্রহ প্রকাশ করে না, সে কিনা প্রিয়নন্দিনীকে দেখবার পর থেকে মনে মনে তার জন্য মাঝে মাঝে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। পরদিন সকালে ধ্রুব’র রুমের দরজার কাছে এসে ফুলেশ্বরীর মা বলল: বাবা ধ্রুব তোমার সাথে একটু দরকারি কথা ছিল। ধ্রুব তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।
- আগামীকাল তোমার সনেই প্রিয়নন্দিনীকে ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা দিতে পাঠাতে চাই। সে নতুন এসেছে। ওর সাথে তো কাউকে না কাউকে যেতেই হবে।
- আমি থাকতে অন্য কাউকে কী দরকার, আমিই ওকে নিয়ে যাব। তাছাড়া আমার সব জানাশোনা আছেই।
- আঙিনা থেকে কাপড় রোদে মেলতে মেলতে ধ্রুব’র মা বলেন, এত ভাবছেন কেন আপা? চিন্তা কি! ধ্রুবই সব ব্যবস্থা করে দেবে।
- তিনজন মানুষের একজনকে নিয়ে এত কথা, এক ধরনের চাপা উত্তাপ ধ্রুবকে যেন অস্বস্থিতে ফেলে দেয়। ধ্রুব তাড়াতাড়ি কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল: খালাম্মা ফুলেশ্বরী আপু কেমন আছে?
- এরি মধ্যে সদ্য পরিচিত প্রিয়নন্দিনী মোবাইল ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে খালাম্মাকে ফোনটা দিয়ে বললো, তার বাবা ফোন করেছেন। প্রিয়নন্দিনী যেন অনেকটা শ্রদ্ধার চোখে তাকালো ধ্রুব’র পানে। এই মুহুর্তে প্রিয়নন্দিনীকে কিছুটা ভীরু মনে হচ্ছে। ধ্রুব তড়িঘড়ি করে টিউশনীর দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমনি সময় খালাম্মা আবার ছুটে এলেন। খালাম্মা জানালেন, প্রিয়নন্দিনীর সাথে ধ্রুব যাচ্ছে শুনে তার বাবা খুশি হয়েছেন। প্রিয়নন্দিনীর মাঝেও এখন বেশ খুশি খুশি ভাব।
- ধ্রুব খালাম্মাকে বললেন, জাস্ট সাড়ে আটটায় তাকে পাঠিয়ে দেবেন। প্রিয়নন্দিনীকে বললো:এক সাথে শাটলে যেতে তো আপত্তি নেই!প্রিয়নন্দিনী মাথা নেড়ে সায় জানাল। এদিকে ধ্রুব তাড়াহুড়ো করে বাইরে আসতে গিয়ে গেট খুলতে খুলতে খেয়াল করলোসে স্যান্ডেল ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে। যতোটা স্বচ্ছন্দে প্রিয়নন্দিনীর কাছ থেকে পালাতে চেয়েছিলো তা আর হলো না। প্রিয়নন্দিনীর সামনে থেকে আবার যখন স্যান্ডেল জোড়া পড়তে গেলো, তার শরীর ঘামে ভিজে যেতে লাগলো। প্রিয়নন্দিনীকে অনেকটা হতভম্ব হতে দেখলো। বাসা থেকে বেরিয়ে আশৈশবের রাস্তাটা অপরিচিত মনে হল। পরিচিত মানুষগুলোর চেহারাগুলো যেন পাল্টানো ও অপরিচিত বলে মনে হতে লাগল। রাস্তায় দেখা হলে মন্টু কাকা জানতে চাইলেন, বাবা কবে ঢাকা যাচ্ছে? ধ্রুব যেন চোখ দুটো দিয়ে অন্যরকম দেখছে। কোনো রকমে জানি না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ধ্রুব। কয়েক পা এগিয়ে আফসোস হলো, বাবা তো বলেছিলেন, আজ রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবে। কেন এমন হচ্ছে ধ্রুব’র!প্রিয়নন্দিনীকে যতোবার দেখছে যে যেন নার্ভাস হয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করে কিছু বলতে। একটা চাপা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।পুরো মনটায় যেন প্রিয়নন্দিনী দখল করে আছে।কখনও আনন্দের গান গেয়ে, কখনো স্বপ্ন ভরা দু’চোখে, কখনও বা তার আত্নার ছায়া সঙ্গী হয়ে। মনে মনে বলে, এটা কি তবে প্রেম!কে জানে। বন্ধুদের কারো কাছে জানতে চাইলে হয়ত বলবে। প্রেমের সংজ্ঞা কি তা সে জানে না।
- ৩
আজ বরষার প্রথম প্রহর। সারারাত দমকা হাওয়া। সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। রাতে জানালা বন্ধ করেই শুয়ে পড়ল ধ্রুব। তবু সিকিউরিটি গার্ডের বাঁশীর আওয়াজ আর রাতভর ট্রেন আসা যাওয়ার কু ঝিক ঝিক আওয়াজ সমানে চলে। হঠাৎ যেন ধ্রুব একাকিত্ববোধ করল। ধ্রুবর হৃদয়টাকে কে যেন লক্ষ পেরেক টুকে রেখেছে। প্রিয়নন্দিনীকে বলতে না পারা কষ্টের তৃষ্ণাগুলো যেন ধ্রুবর মনে বেড়েই চলে। ধ্রুব অনেক দূরের স্বপ্ন মাখা নীলগুলোকে চোখে ভাসিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে। আজ থেকে নতুন কোনো দিগন্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করবে ধ্রুব। যে বিশ্বাসটুকুন নিয়ে জাগরণে, স্বপ্নে প্রিয়নন্দিনীকে তার সামনে দাঁড়া করাতে চাইছে তাতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। আজকে যদি প্রিয়নন্দিনীর সাথে সহজভাবে মিশতে না পারে, তবে প্রিয়নন্দিনীকে আজ থেকে গলে যাওয়া আইসক্রিমের মতো ফেলে রাখবে ধ্রুব।
ধ্রুবর রুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল। সকাল সাড়ে আটটার কয়েক সেকেন্ড আগে দরজার সামনে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ধ্রুব দরজাটা আলতোভাবে খুলে দিল। প্রিয়নন্দিনী এসে গেছে। হালকা টিয়েরঙের প্রিন্টের জর্জেট থ্রিপিস গায়ে, হাতে একটা ফাইল, ফাইলের ওপরে ছোট একটা পার্টস। শরীর থেকে হালকা বডিস্প্রে’র সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে রুমময়।ধ্রুব বলল: চলুন। বলতে বলতে টেবিলের ওপর রাখা যে ক’টা টাকা ছিল তাই পকেটে পুরে নিয়ে মা’কে খোদা হাফেজ জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রিয়নন্দিনীকে সাথে নিয়ে।
শাটল আসল স্টেশনে। ভর্তিপরীক্ষা ঘিরে আজ সব বগিতে অসম্ভব ভিড়।এমনকি ধ্রুব’দের দখল করা ‘শৃঙ্খলিত মুক্তি’ বগিটিও। অর্থনীতির বন্ধু তারিককে রাতে বলে রেখেছিল বলেই ওদের ‘আরণ্যক কবিতা’ বগিতে সামনা সামনি দুটো সিট পেয়েছিল। ট্রেন চলছেই। মেঘ থম থম আকাশ ফুঁড়ে বাইরে ঝুম বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চমকানো, মেঘের হুঙ্কার সমানেই চলছে। দু’জনার মুখে কোনো কথা বা শব্দ নেই একটিও। ধ্রুবর মনে হল, একটা পাথরের মূর্তি তার সামনে বসে আছে। পরীক্ষার্থী বন্ধুরা কেউ কেউ পড়ছে, কেউ কেউ গল্প,কথায় এগিয়ে চলছে। প্রিয়নন্দিনী কোনো বইপত্রই সাথে আনেনি।সে মুগ্ধ হয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছে।
বৃষ্টি কমে এসেছে। হঠাৎ ট্রেনের বাইরে কিছু ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখে প্রিয়নন্দিনী এই প্রথম ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খুব উৎফুল্লতার সাথেই উপভোগ করতে লাগল। নিজের চোখকে যেন ধ্রুব বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেন প্রিয়নন্দিনী ক্রিকেট খেলা দেখে এত খুশি।একবার ধ্রুব’র চোখ দিয়ে প্রিয়নন্দিনীকে জরীপ করল। ধ্রুব ভাবল, আমরা সবসময় স্বার্থপরের মতো নিজের কথাটাই ভাবি।অথচ পাশের লোকটি কী ভাবছে দেশ, সমাজ নিয়ে তা জানলে, আলোচনা করলে আমাদের অনেক বিষয়ে চোখ মন খুলে যায়। কই তেমনটি আমরা কেউ করি না। খেলার মাঠটা পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে। প্রিয়নন্দিনীর উচ্ছ্বাস ভরা হাসিতে ধ্রুব অবাক হলো। শাটলে চড়ে মাঠে এরকম ক্রিকেট খেলার কত দেখার দৃশ্য দেখে দেখে যায় শিক্ষার্থী বন্ধুরা। কিন্ত্ত কোনো মেয়ের চোখে মুখে এমন উচ্ছ্বাস, আনন্দের জ্যোতি দেখতে অনভ্যস্ত ধ্রুব। অস্বস্থি লাগলে ধ্রুব মাঝে মাঝে স্মোকিং করে। আজও সিগারেট ধরাল। দুটো টান দিয়ে কী জানি মনে করে জ্বলন্ত সিগারেটটি নিভিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরিবেশ হালকা করার জন্য সহাস্যে জানতে চাইল,
- ক্রিকেট খেলা আপনার খুব প্রিয়?
- ছোট্ট করে জবাব দিল, হ্যাঁ।
- আপনি খেলতে পারেন?
- হ্যাঁ।
- আমার সাথে খেলবেন? আমি খুব ভাল খেলি।
- প্রিয়নন্দিনীর অবয়বে এক ধরনের কোমল দ্যুতি ছড়াল। সাথে ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাসিও ছলকে ওঠল। জানতে চাইল, সত্যিই আমায় খেলতে নেবেন! আমিও বেশ পারি। সত্যি সত্যিই।
- ধ্রুব জানল, শুনল প্রিয়নন্দিনীর মনের আকুলতার কথা। মনে মনে বলল, এই এক গোলক ধাঁধা যেন। প্রিয়নন্দিনীর ক্রিকেট খেলার ক্ষমতা থাকা এই সমাজের জন্য পাপ। কতটা গভীর বেদনার তা কী করে বোঝাবে তাকে। ততক্ষণে ট্রেন ভার্সিটি স্টেশনে পৌঁছায়। দ্রুত নেমে ধ্রুব একটা রিকশায় ওঠলো, প্রিয়নন্দিনী তাকে অনুসরণ করল। ধ্রুব গর্বিত মনে ভাবে,তোমাকে বন্ধু হিসেবে পেযে আমি খুব খুশি।আরো নানা প্রশ্ন ঢেকুর তোলে। রিকশায় বসে,ধ্রুব বলে, আপনাকে দেখে মনে হয়, কেউ বুঝি আপনার কাছ হতে কিছু কেড়ে নিয়েছে, নয়তো আপনি কিছু হারিয়েছেন।প্রিয়নন্দিনীকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবার বলল:
- আপনি কি মনে করেন, তৎকালীন সময়ে নারীদের খেলার ব্যাপারে যে পারিবারিক, সামাজিক প্রতিকূলতা বজায় ছিল,তা আজো রয়েছে?
- হ্যাঁ। আছে তো। ছোটবেলার সত্তা আলাদা। বড় হতে হতে ব্যাট, বল এগুলো আমার জন্য পাপ হয়ে যায়। আমি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সমাজের কাছে হয়ে যাই অপয়া। আমার পরিবারকে কত সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।
বলতে বলতে নিজের ভেতরের জমানো জলগুলো দুচোখে জমে চিক চিক করছে দেখে ধ্রুব বলে, সমালোচনা, তির্যক কথাবার্তা এগুলো মানুষকে জয়ী হবার তাগিদ দেয়।মনে মনে বলে, এই ক্রিকেট ভালোবাস বলে তুমি আমার কাছে আরো অধিক প্রিয় হলে প্রিয়নন্দিনী।
- তুমি বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলও খেলা সম্পর্কে কী জান?
- তেমন না। শুধু জানি, নারীরাও খেলে।
- জানতে চাও?
- হ্যাঁ।
- ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের একটি নারী ক্রিকেট দল ইডেন গার্ডেনসে খেলে। স্থানীয় দলের বিপক্ষে সে ম্যাচে বাংলাদেশের দলের হয়ে খেলেছিলেন পারভিন নাসিমা নাহার পুতুল। তিনি একজন এ্যাথলেট, ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সমানে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।চলতি বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে নারী ক্রিকেট দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশের এই নারী ক্রীড়াবিদ। তিনি কী পদে পদে সমালোচনার মুখে পড়েননি! মন্তব্য, কটু কথা শুনেননি? বরঞ্চ সমালোচনাই তাকে জয়ী হতে শিখিয়েছে।
- ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীকে জ্বালিয়ে যেতে চায় তার আত্নবিশ্বাসকে জাগিয়ে। যেন একটা জ্বলন্ত প্রহর জাগাতে পারে সেই চেষ্টা থেকেই ধ্রুব কথাগুলো বলেছিল।
রিকশা আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে এসে থেমে যায়। আর যাওয়া যাবে না। পরীক্ষার্থীর ভিড়। ধ্রুব রিকশা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে বাকী পথটুকু হেঁটে গিয়ে ফ্যাকাল্টির বাইরের বোর্ডে প্রিয়নন্দিনীর রোল নাম্বার দেখে, তাকে নির্দিষ্ট কক্ষের সিটে বসিয়ে দেয়। বলল, পরীক্ষা শেষ হলে সামনের বারান্দায় যেন অপেক্ষা করে। ধ্রুব এসে সাথে নিয়ে যাবে। প্রিয়নন্দিনী মাথা নেড়ে সায় জানায়।
পরীক্ষা শেষে ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীকে নিয়ে নিচে এসে রিকশা নিল। ধ্রুব রিকশাঅলাকে চলতে বলল। রিকশা ফ্যাকাল্টি হয়ে আঁকাবাঁকা পথে হলগুলো ছাড়িয়ে স্টেশনে থামে। তারা মউ’র দোকানের ঝুপড়িতে বসল। গরম চা, সিঙ্গাড়া নিল। দু’জনে খেল।প্রিয়নিন্দিনী পার্টস খুলে টাকা দিতে চাইল। তার পূর্বে ধ্রুব পিচ্চিটাকে ইশারা করাতে সে ধ্রুবর কাছ হতেই টাকা নিল।
বাসায় পৌঁছাতেই ধ্রুবকে খালাম্মা জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয়নন্দিনী কেমন পরীক্ষা দিল।
- খালাম্মা তাকে জিজ্ঞেস করো। আমি জানতে চাইনি।
- খালাম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যদি না টিকে প্রিয়নন্দিনীর কপালে খারাপি আছে। আবার তাকে দেশের বাড়ি ভোলা পাঠিয়ে দিতে হবে। আর দেশে গিয়ে ব্যাট,বল, ক্রিকেট নিয়ে শুরু হবে পাগলামি। আমার ভগ্নিপতি ঠিক বিয়ে দিয়ে দেবেন।
- ধ্রুব কিছু না জানার ভান করে বিস্ময় প্রকাশ করে, তাই নাকি? প্রিয়নন্দিনী ক্রিকেট প্লেয়ার!
- হ্যাঁ বাড়িতে সকলে বদনাম করছে এ নিয়ে।মৌলভী বাড়ির মেয়েরা এসব পারে না। তাইতো আমার বোন এখানে পাঠিয়ে দিলেন।
- তাই বুঝি! তবে তাকে এখানে একটা ক্রিকেট টীমে জয়েন করিয়ে দিই!
- আরে নাহ। এসব ওর বাবা-মা’ই বারণ করে দিয়েছে।
মনে মনে ধ্রুব প্রিযনন্দিনীর একস্ট্রা ব্যক্তিত্বকে আন্তরিকভাবে স্যালুট জানায়।
৪
ইতিমধ্যে প্রিয়নন্দিনী ভার্সিটিতে সোসিওলজিতে চান্স পায়। ধ্রুব ভর্তি প্রক্রিয়ার যাবতীয় কর্মে সহযোগিতা করে গেল। পাশাপাশি প্রিয়নন্দিনীকে নিয়ে নিজের আবেগকে ঢেলে সাজাতে লাগল। প্রতিদিন শাটলে করে ক্লাশ থাকুক, না থাকুক এক সাথে যায়, ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে, শহিদমিনারের সামনে, ঝুপড়িগুলোতে, জারুলতলায় তারা গল্প করে। জীবনের কথা বলতে যেন ভালোবাসত। আবার বিকেলে সকলের অগোচরে কলোনীর পেছনের পরিত্যক্ত বাসাটির সামনে ক্রিকেট খেলতো। প্রিয়নন্দিনীর আপাদমস্তক অবিকল ধ্রুবর মতই আনন্দে অনিঃশেষ কেঁপে ওঠতো, নিমিষেই তার আনন্দের ছোঁয়ার উষ্ণতা ধ্রুবর সবকিছু যেন গ্রাস করে নিতো।ধ্রুবর মনে হতো এ যেন ভিসুভিয়াসের উন্মত্ততার মতো, কখনও এ খুশির ঝিলিক নি:শেষিত হওয়ার নয়।
আর ধ্রুবরা যখন মাঠে খেলত, প্রিয়নন্দিনী বাড়ির আশপাশের বেশ ক’জন সমবয়সীরাও সেখানে বসে খেলা উপভোগ করতো, ঠিক ফুলেশ্বরী আপুদের মতোই তারাও খেলা উপভোগ করতে করতে আচার, বরই, জলপাই, আমড়া কত কী খেতো।
এভাবে প্রিয়নন্দিনী যেন ধ্রুবর জীবনের ছণ্দগতি হয়ে যায়। মনে হয় সে আছে বলেই তারও বেঁচে থাকবার স্বাদ বেড়ে যায়। সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্নগুলো এসে ধরা দেয় হৃদয় মাঝে। কিন্ত্ত ধরাধামে দুজনার অনাবিল এ সুখ সইল না। বুকের ঘরে দহন আক্রান্ত হতে সময় লাগল না।খালাম্মা জেনে যায়,এমনকি হাতে নাতে ধরে ফেলে ধ্রুব আর প্রিয়নন্দিনীর ক্রিকেট খেলা্র দৃশ্য।সেই থেকে ধ্রুবর ওপর যেমন বাসা থেকে তির্যক দৃষ্টি, তেমনি প্রিয়নন্দিনীর ওপরও নির্যাতনের অনেক মানসিক ঝড় বয়ে যেতে লাগল। প্রিযনন্দিনীকে আর আগের মতো দেখা যেত না। এমনকি শাটলেও না। বান্ধবীদের মাধ্যমে জানা গেল সে লোকাল পরিবহনে যায়। তবে নিয়মিত না। একবার অনেকদূর থেকে দেখা হয়েছিল, কিন্ত্ত ধ্রুব’র মুখে যেন কথাই জুটলো না। অন্তত প্রিয়নন্দিনীর কষ্টগুলোর জন্য সে অপরাধী হয়ে ক্ষমা চাইতে পারত। কিন্ত্ত বলতে গিয়ে সব ভুলে গেছে। তার মাথাটাও কাজ করলো না। সেই থেকে ধ্রুবর অবচেতন মনে যেন শুধু প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ প্রিয়নন্দিনীকে খোঁজে। মাঝে মাঝে শাটলের এই বগি থেকে সেই বগি বাকী রাখে না। বাড়িতে দু’জনার মাঝে যেন একটা কাঁচের দেয়াল তৈরি হল। দেখা হলেও কথা হয় না।
প্রিয়নন্দিনীর বড় বড় চোখদুটিও আপনের মতো শুধু আড়ালে আবড়ালে ধ্রুবকে খোঁজে।এ কোন মায়াজাল! এ কেমন মায়ার বাঁধন! ধ্রুব’র প্রতি! পাষাণের ধু-ধু রাজ্যে সীমাহীন তেষ্টার মতো বারবার ধ্রুবকে এক নজর দেখবার তেষ্টা পাচ্ছে।ধ্রুবকে দেখতে না পেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে প্রিয়নন্দিনীর বুক।
একদিন শাটল ভার্সিটি স্টেশনে পৌঁছালে প্রিয়নন্দিনীকে দেখতে পেয়ে ধ্রুব দৌঁড়ে কাছে আসে। প্রিয়নন্দিনী!প্রিয়নন্দিনী বলে ডাকতে ডাকতে একদম সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। ধ্রুবকে দেখবার সাথে সাথে প্রিয়নন্দিনীর বড় বড় চোখদুটো থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে থাকে। তার বুকের ঘরের দহন অনুভব করতে পারে ধ্রুব। এই প্রথম সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অজান্তে মনের টানে প্রিয়নন্দিনীর একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নেয়। ধ্রুব এক নিঃশ্বাসে বলে, তোমার মনের ওপর কোন রাগ, অভিমান রেখো না, সব দোষ আমিই করেছি। আমিই তোমাকে খেলবার জন্য ডেকেছি। তাই সব রাগ আমার ওপর ঝাড়ো। যেভাবে খুশি। প্লিজ আমার নন্দিনী! আমায় ক্ষমা করো।
– তুমি মহৎ মনের মানুষ। তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না। আমি মাঝে মাঝে শাটলে ওঠলে তোমাকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। না পেয়ে হতাশ হয়ে একাকী মনে চলি।
– আমিও তোমায় অনুরূপ খুঁজি। পরে একাকী চলি, ফিরি।বন্ধুবান্ধবও ভালো লাগে না। ধ্রুব বলে, প্রিয়নন্দিনী আমরা পরস্পর আপন হয়েছি হারিয়ে যাবার সম্পর্ক নিয়ে নয়। আমাদের মনপ্রাণ জানে আমরা কেমন আপন। কেমন ভালোবাসা আমাদের মাঝে।
-সকলের চাপে ধ্রুব আমি তো কতবার ভুলে যেতে চেয়েছি তোমায়। মনতো তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু চিনতে চায় না।
ধ্রুব ভাবে তাদের মাঝে কখনও ভালবাসি কথাটাও উচ্চারিত হয়নি।ধ্রুব যা ভেবেছে তা তো প্রকাশ করতেই পারেনি।প্রিয়নন্দিনীও কখনই বলেনি। আজ প্রিয়নন্দিনী নিজের প্রতি গভীর আবেগকে ধরে রাখতে পারল না, অসস্ভব উচ্ছ্বাস ভরে মুখ থেকে প্রকাশ অজান্তেই ধ্রুবকে আপনি থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে চলল।
-জানো প্রিয়নন্দিনী! মন একটা নীলোৎপল আকাশ। সেখানে তোমার আমার দূরন্ত ছুটাছুটি। কে বলেছে তোমায় আমায় ভুলতে। মনতো সব সময় বলছে, তোমার মন আমার আত্নার খাঁচায় বন্দী।
প্রিয়নন্দিনীর বাবা ভোলার একটি হাইস্কুলের মাস্টার। মেয়ে ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট এর ব্যাট বল পছন্দ করতো বলে, বাবা আবদার অপূরণ রাখেনি। তবে বড় হয়ে সকলের মতো শাসনে জড়িয়ে বলেছেন, পারলেও মা আমি তোকে খেলার অনুমতি দিতে পারি না। তুই মৌলভীবাড়ির মেয়ে। সমাজ বলে একটা কথা আছে। এভাবে বড় হতে হতে পাঁচজনের মুখে পাঁচ রকমের কথায় মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে ফুলেশ্বরীর মা নিজ দায়িত্বে প্রিয়নন্দিনীকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কারণ সে ভালো ছাত্রী। তাছাড়া ফুলেশ্বরী না থাকাতে তাদের ভালো লাগে না। আসবার সময় বাবা বলছিলেন, মা, মনে দুঃখ রাখিস না। আমি বাবা হয়ে যা পারিনি। অন্য বাবারা তো তা পারছে। অনেক মেয়েই ক্রিকেট, ফুটবল, এ্যাথলেট খেলছে। তারা আন্তর্জাতিকভাবে বিজয়ী হচ্ছে। দেশের জন্য অহংকার বয়ে আনছে। আমি সামাজিকভাবে বন্ধ্যা। আমাকে তুই ক্ষমা করিস। প্রিয়নন্দিনী তাই বাবাকে কখনও ছোট করে দেখেন না। সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন।
ধ্রুব বুঝতে পারে, ধ্রুব’র সাথে প্রিয়নন্দিনীর ক্রিকেট খেলা বন্ধ হওয়াতে তার মনে কী পরিমাণ উদাসীনতা কাজ করছে।সবকিছুর প্রতি তার যেন প্রাণোল্লাস থেমে গেছে।প্রিয়নন্দিনীর বুকে সীমাহীন কষ্টের রক্তের নদী বয়ে চলেছে। এই তো ওপর থেকে বোঝা সম্ভবপর না। প্রিয়নন্দিনীর দুচোখে বৃষ্টির মতো অশ্রু জল , যেন ধ্রুব’র প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বস্ততার ভালোবাসা প্রকাশ করছে। ধ্রুব’র ইচ্ছে করছিল নিজহাতে সে তপ্ত জল মুছে দিতে। একটু ইতস্তত করলেও জারুল তলায় বসে কথা বিনিময়ের ছলে যখন দুজনে ওঠে যাচ্ছিল ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীর মুখখানি আদর করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। বলল,তোমার কষ্টের ঝর্ণারা এখানে সব জল ঝরিয়ে নিক। আমার মনটা এমনিতেই উদাস তপ্ত দুপুরের ধুলোবালির মতো শুকনো হয়ে আছে। তুমিহীনা প্রতিক্ষণ ফাঁকা ফাঁকা। একা একা লাগে।ধ্রুবর বুক হয়ে হৃদপিণ্ডে তপ্ত রক্তপ্রবাহের মতো সব যেন জলে ভিজে যাচ্ছে।কেন এমন হচ্ছে! প্রিয়নন্দিনীর কান্নার নোনাজলে গোপন কোনো বেদনাভার মেশানো। ধ্রুবর সর্বাঙ্গে কম্পমান উচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে।প্রিয়নন্দিনী যেন কিছুতেই ব্যালান্স রাখতে পারছিল না। ধ্রুবর নিঃসংকোচ প্রচেষ্টায় পারছে না প্রিয়নন্দিনীর নয়নের জলধারা প্রপাত থামাতে।ধ্রুব বোঝতে পারে না, তবে এটাই কী ভালোবাসা!
প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব কথা দেয় আজ থেকে ধ্রুবর বুকের মাঝে তার ঠাঁই। আর তার শেষ বর্ষ চলতে চলতেই সে একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে। তারপর পারিবারিকভাবে উভয় পরিবারের সম্মতি না পেলে দুজনেই আইনসম্মতভাবে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবে। ভালোবাসার সাধনায় দুজনে সিদ্ধিলাভ করবেই।
৫
প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব বলে, কিছুটা দূরত্বের মাঝে আমাদের সম্পর্ক বজায় থাকুক। কেউ আপাতত জানবে না। প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব খুব গোপনে খবরাখবর দেওয়ার জন্য একটা উপায় বের করে দেয়।
পাহাড়তলী রেল ইস্টিশানের পাশ ঘিরে হতদরিদ্র শ্রেণির ঘন বিন্যাস্ত প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হাজার তিনেক ঘর। বসতিঘরকে সংকুচিত করে বানানো এ ঘরগুলোকে ইস্টিশনের বস্তিঘর বলা হয়।এটাই তাদের ঠিকানা, ইস্টিশনের বস্তিঘর। যারা বসবাস করে তাদের জীবনের প্লট নেই, তবে আবার তারা অনেক কবি, সাহিত্যিকের গল্প, কবিতা, উপন্যাসের প্লট হয়ে যায়।
ধ্রুব শৈশব থেকে এই বস্তি, বস্তির পরিবেশের সাথে পরিচিত। সকালবেলা থেকেই দেখে কেউ নির্জনে রোদে বসে বসে কাপড় শুকোয়। কেউ দাঁত মাজে, কেউ রোদ পোহায়,সারাদিন রাত চায়ের ঝুপড়িঘরগুলো খোলা থাকে। গান বাজে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে উনুনে ফুটন্ত জলের ডেকচি বসিয়ে অবিরত চা করে মিঠুন কাকা। বস্তির সকলের সাথে তার যেমন ভাব, তেমনি কলোনীর সকল পরিবারের সাথেও তার ভাব বিনিময় ও সখ্যতা একইতালে চলে। তবে বেশি সম্পর্ক ঠিকে ঝি, বুয়াদের সাথে। মিঠুন কাকা এদের কাজ জুটিয়ে দেয় ধনী লোকজনের বাসাবাড়িতে। তাতে নিজেরও পকেট ভারি হয়। বুয়ারা সকালে কর্মস্থলে যাবার আগে কাকার দোকানের চা, বিস্কুট, পান, বিড়ি খায়। গল্প করতে করতে সাথে কিনেও নেয়। বস্তির ও কলোনীর কিছু তরুণ-তরুণীকেও দেখতে পাওয়া যায়।বস্তির মেয়েগুলো যারা স্কুলেও পড়ে আবার বাবা-মা কর্মস্থলে যাবার পর ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনায় সময় দেয়।স্কুল বলতে বস্তি এলাকায় এনজিওদের দেয়া স্কুলগুলোকে বোঝায়। একটি বড় বড় কক্ষ ভাড়া করে তারা স্কুল ঘর গড়েছে। কোনোটির নাম ‘প্রভাতী স্কুল’, কোনটার নাম ‘স্বপ্নময় জীবনসাথী’, কোনটার নাম ‘বর্ণমালা স্কুল’ আনন্দময়ী ‘বিদ্যানিকেতন’ ইত্যাদি।ওসব স্কুলের মাস্টারনীরাও কাকার দোকান থেকে চা, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে খায়। বুড়ো-বুড়ি টাইপের যারা, গল্প করতে খুব ভালোবাসে। তারাও বসে থাকে গল্প করে, চা পান করে,পান খায় কাকার দোকান থেকে।কাকা পড়তে না পারলেও একটি বাংলা দৈনিক রাখে একেকজন এসে সেটা সকলকে পড়ে শোনায়। কাকার সাথে ধ্রুবদের মতো ছেলেদের খুব ভাব। তাদের গোপনীয় অনেক ব্যাপারে কাকা সহায়তা করে। বিনিময়ে কিছু সুবিধাও পায়।ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীকে দোকানের মিঠুন কাকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মোবাইল যোগাযোগে সমস্যা হলে চাচার হাতে পত্র দিয়ে যায়। এভাবে এক নিরব প্রেমের রূপ নেয় প্রিয়নন্দিনী ও ধ্রুব’র মাঝে।কাকার মাধ্যমে তাদের ভাবলেশহীন প্রেম আবার একই সূতোয় গাঁথা হতে থাকে।
একদিন সকালে মিঠুন কাকা সকালে জরুরি ফোন করে একটা চিঠি দেয়।তাতে লেথা ,ধ্রুবতারা , রোযা ও ঈদের বন্ধের পুরোটায় ছুটি ভোলায় কাটাতে হবে। বাবা মা’র সিদ্ধান্ত।ইতি তোমার প্রিয়নন্দিনী।
বসন্তের বিরহের মতই হতাশ হয়ে পড়ে ধ্রুব’র মনটা। দুদিন পরেই ভার্সিটি বন্ধ হবে। মাঝে মাত্র একদিন। ধ্রুব আর প্রিয়নন্দিনীর কতো কথা বাকি। যা বসন্তের মুকুলগুলোর মতো থমকে আছে। ভার্সিটি বন্ধের ২দিন আগে ১ ফাগুনের উৎসব। প্রিয়নন্দিনী ভার্সিটির শাটল থেকে নামল।পাশাপাশি বগি থেকে। নেমেই ধ্রুবর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার সর্বাঙ্গে বসন্তের পরশ। সকালের এই পুস্পসাজ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে নন্দিনী!দুহাতে বকুল ফুলের মালা, লম্বা বিনুনিতে বকুলমালা জড়ানো। মনে হচ্ছে ফুলগুলো সব প্রজাপতি হয়ে ওকে রাঙ্গিয়ে রেখেছে। হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে চারদিকের ঘাসফুলগুলো।
- চল। আজ ঝর্নার ধারে গল্প করবো।
- দুজনেই হাত ধরাধরি করে চারদিকের বাসন্তী হাওয়ার ছোঁয়ায় হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলে।আজ দিনটা সত্যি সুন্দর লাগছে। গাছগুলো যেন ঝকঝকে রোদ আর হালকা হাওয়ায় দুলুনি খাচ্ছে। প্রকৃতি যেন লাল সবুজে সেজেছে। শিক্ষার্থী বন্ধুরা বাসন্তী রঙে সেজেছে। অনুষ্ঠান হচ্ছে। সুরের মূর্ছনা চতুর্দিকে।গানের সুরে সুরে সকলের মতো গুন গুন করে ধ্রুব ও প্রিয়নন্দিনী গায় ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা, বইল প্রাণে দখিন হাওয়া, আগুন জ্বালা’। সত্যি গানে গানে যেন বসন্তের অনুভব জেগে ওঠছিলো।
- প্রিয়নন্দিনী আর ধ্রুব ঝর্ণার পাড়ে বসে। ধ্রুবর গলায় একটি বকুল ফুলের মালা পরিয়ে দেয় প্রিয়নন্দিনী। বললো, এই বসন্তে এই মালা তার ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে রইল।সকলের অগোচরে দুজন দুজনার আপন হয়ে ওঠে।ধ্রুব কাল টিউশানীর এডভান্স টাকা নিয়েছিল। প্রিয়নন্দিনীর জন্য একটা স্বর্ণের রিং কিনেছিলো। ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীর অনামিকায় রিংটি পরিয়ে দেয়।দুজনে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয় মিষ্টি করে। মনে হল তাদের ঘিরে ভালোবাসার কোনো অমিয় বিতান জেগে ওঠেছে।তাদের এতদিনের নি:সঙ্গতার প্রহরগুলো ভালোবাসার আলোকছটায় ভরে ওঠেছে। মধুর প্রেমের স্নিগ্ধতায় অমিয়ধারা স্পর্শে প্রাণ পেয়েছে।যেমন করে বসন্ত প্রকৃতির ছোঁয়ায় গাছগুলোর ডগায় চিকচিক করে নতুন পাতা ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ধ্রুব আর প্রিয়নন্দিনীর সুখে লুটোপুটি দেখে তারাও হেসে কুটি কুটি। আর অদূরে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটা লাল সবুজে সেজে অপলক তাদের দিকে চেয়ে আছে, কখনওবা তাদের ভালোবাসার বিশুদ্ধ স্বাক্ষী হয়ে ঝিরঝিরে হাওয়ার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ নিরালায় তারা গাছটির নিচে বসে।
আগামীকাল চলে যাবে প্রিয়নন্দিনী।দীর্ঘ দেড়মাস আর দেখা হবে না। ভাবতেই ধ্রুবর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আকাশজুড়ে নক্ষত্রের মায়াভরা আলোর আবেগি হাতছানি যেন। সন্ধ্যা ডাকে নির্ঘুম রাত। এ সময়ের মাঝে আনমনা নির্জন সওয়ার হয়ে, গোপন সহচর হয়ে থাকে প্রিয়নন্দিনী। আধখোলা দরজা। অপেক্ষা করে আজ কোনো এক রাতের তারা হয়ে ওরা দেখা করবেই। প্রায় মধ্যরাত।প্রিয়নন্দিনী দরজায় টোকা দেয়। ধ্রুব খালিপায়ে নি:শব্দে বাইরের আঙিনায় আসে।বাঁধভাঙ্গা জোছনার আলোয় প্রিয়নন্দিনীকে দেখে ধ্রুবর মনে হল আকাশের অজস্র নক্ষত্রমালা থেকে একটি বুঝি খসে এসে পড়েছে ধ্রুব’র হাতে। সুন্দর করে সেজেছে, গোলাপি ঠোঁট জোড়ায় হালকা লিপিষ্টিক,খোলা শ্যাম্পু করা ঝরঝরে রেশম কালো চুল।
- ধ্রুব কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারে না। বকুল তলায় ঝরা ফুলের ওপর তারা বসে। ধ্রুব বলে , নন্দিনী! পূর্ণিমা রাতে কোনো তারাদের কুঞ্জ হতে এলে তুমি ধরার মাঝে।বসন্তের এই নিঝুম রাতের আধাঁরেও আমি তোমার প্রেমের খুশিতে আত্নহারা, স্বপ্নাবিষ্ট। তুমিহীনা একাকী কেমন করে কাটবে আমার দিনগুলো! আমার সব কাজের প্রেরণা কে দেবে? ধ্রুব আকুতি জানায়, প্রিয়নন্দিনী এরাতে তুমি আমার কাছে যেভাবে তারা হয়ে আলো নিয়ে এসেছো, যতদূরে থাক যেন কালো মেঘ এসে তাতে বাধা হতে না পারে খেয়াল রেখো। আমিতো তোমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবো। তাদের কথোপকথের মাঝে হঠাৎ গাছের ওপর একটা কুহক পাখি কুউ কুউ স্বরে ডাক দিয়ে ওঠলো। দুজনে বিস্ময়ে চমকে ওঠলো। পাখিটি আবার ডেকে ওঠে। অনাকাঙ্খিত এ ডাকে দুজনেই যেন ঝাপসা দেখতে লাগলো।দুজনের মনে অদৃশ্য উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার চাপা রেখা ফুটে ওঠে। পাখির এই কুরব মোটেই শুভকর নয় বোঝতে পারে।ধ্রুব মনে মনে ভাবে প্রকৃতিও কি ক্ষুদ্ধ কিছুর আভাস দিতে চায় তাদের প্রেমে! ধ্রুবর বুকের মাঝে মাথা গুঁজে অজোর ধারায় কাঁদতে থাকে প্রিয়নন্দিনী। প্রিয়নন্দিনী তার দ্বিধা ব্যথার সকল কথা এ কান্নার জলে বোঝাতে চায়। ধ্রুবর বুকটা যেন প্রিয়নন্দিনীর কষ্ট লুকাবার ভেলা হয়ে যায়। তার বলা, না বলা সব কষ্ট,আনন্দ ভেজা কাশফুলের মত জল হয়ে টুপটাপ ধ্রুবর বুকে জমা হয়।
বিকেলে প্রিয়নন্দিনীর বাবা আর মেয়ে এক সাথে রওয়ানা দিলেন ভোলার উদ্দেশে। সবার অলক্ষ্যে এসে প্রিয়নন্দিনী ধ্রুবর কাছ থেকে নয়নভরা জল নিয়ে বিদায় নিতে এসেছিল্। বিদায়বেলায় ওর ছল ছল আঁখিপানে তাকানো যাচ্ছিল না। ধ্রু ‘র চোখের কোণে জল লুকিয়ে রেখে হালকা হেসে বলে, কেন এভাবে কাঁদছো? এ বিদায় কী শেষ বিদায় বলছে তোমার মন-প্রাণ? আমাদের আবারও দেখা হবে। প্রিয়নন্দিনী কান্নাভারি কন্ঠে বলে, ফুলেশ্বরী আপুর বই’র আলমীরায় আমায় পাবে। দুজন দুজনার কপালে চুমু দিয়ে বিদায় দেয়।
৬
প্রিয়নন্দিনী চলে যাবার পর ধ্রুবর সময়গুলো দৈর্ঘ্যে যেন বেড়ে যেতে লাগল। এতক্ষণে ফোনে অন্ততপক্ষে একটা এসএমএস দিতই। সুযোগ পেলে অল্প স্বল্প কথাও এড়িয়ে যেত না।এলোপাথাড়ি চিন্তা, অস্থিরতার মাঝে মধ্যরাত শেষ হয়ে আসে। ধ্রুবর মা প্রেসারের রোগী। চুপিসারে মা’র রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি দিয়ে ১টি ঘুমের বড়ি খেয়ে নিল। ধ্রুব কখনও ঘুমের বড়ি খায়নি। তাই মনে হল খুব তাড়াতাড়ি বড়ির এ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে।চোখের পাতা ভেঙ্গে তার এত ঘুম এলো মনে হর বুঝি কখনও এ ঘুমআর ভাঙ্গবে না। ঘুমের মধ্যেই সে হারিয়ে যাবে মনশূন্যপূর নামক মৃত্যুর অতলতলে। কিন্ত্ত সকালে বন্ধু শাম্মীর ডাকে ঘুম ঠিকই ভাঙ্গলো। দুজনে একটা বিদেশী কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা, একসাথে বের হয়। ইন্টারভিউ তেমন ভালো হয়নি। তবু দুজন সারাদিন এদিকওদিক ঘুরে চমৎকার একটা সময় কাটালো যেন। সন্ধ্যায় টিউশানী শেষে বাসায় ফেরে ধ্রু্ব।
ধ্রুব বাসায় এলেই চোখে যেন সবকিছু যেন এলোমেলো দেখে। প্রিয়নন্দিনীর সাথে এতদিনের তার বন্ধুপ্রীতি ও পরে প্রেমের আবেগগুলোর স্মৃতিরা যেন একসাথে স্রোতের ন্যায় ভেসে ওঠে। প্রিয়নন্দিনী তার বান্ধবী নদীর একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলেছিল, যদি তার সাথে যোগাযোগে সমস্যা হয়, তবে যেন এ নাম্বারে ফোন করে তার খবর জানতে। ধ্রুব নাম্বারটি সেভ করে,প্রেস করে।ওপার থেকে সালাম দিয়ে জানাল, আমি নদী, প্রিয়নন্দিনীর সাথে পড়ি, ওর বন্ধু।
-আমি ধ্রুব বলছি। কেমন আছেন।
– ভালো আছি। আপনি আমাকে আপনি বলবেন না। আমি প্রিয়নন্দিনীর বান্ধবী, আপনারও বান্ধবী।
-ধন্যবাদ বন্ধু।
ফোনটা কেটে দিয়ে ধ্রুব নিশ্চিত হল যে,নদীকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবা যায়।
শেষ রাতে ধ্রুবর একটু মাথা ব্যথাও গায়ে জ্বর জ্বর এসেছিল। ধ্রুবর মা রুমে কবে রুমে এসেছিল জানতে পারেনি। সকালে দেখে, টেবিলে এক গ্লাস দুধ।গায়ে হালকা একটা ফুল করা নকশী কাঁথা।
এরকম যত্ন পাওয়ার জন্য মা’কে সকালে একটু জড়িয়ে ধরে আদর জানায়। ধ্রুব বলল, আজ এক বান্ধবীর বিয়ে।কিছু টাকা দিতে পারো মা? মা একটু স্নেহময় হেসে জানাল,চারশো পারব। ধ্রুব খুশি হয়ে যায়। ধ্রুব তাড়াতাড়ি মায়ের হাতের বানানো পাটিসাপটা পিঠা আর চা খেয়ে রুমে গিয়ে টুকটাক গোছানো শুরু করে। এরি মধ্যে ফোন এল প্রিয়নন্দিনীর। সাদামাটা কথা, সে ভালো আছে।
ধ্রুব’র খুব রাগ হল।মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল, প্রিয়নন্দিনীর এসএমএস।‘তুমি কিছু বোঝ না! আমার ওপর খুব প্রেসার যাচ্ছে।’
ধ্রুব ফোন করে,এসএমএস দিয়ে প্রিয়নন্দিনীকে কোনো রকম বিপদে ফেলতে চায় না।যতক্ষণ ভয়ের পরিবেশ একটা অনুকূল হাওয়ায় না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দুজনকেই থাকতে হবে বরফ শীতল অবস্থায়। যেন তাদের বোঝাপড়ার ভাবনার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
নদীকে ফোন দেয় ধ্রুব। জানতে পারে প্রিয়নন্দিনীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার বাবা মা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হয়ত তার আর ফেরা হবে না।
ধ্রুবর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাথাটা যেন চক্কর খায়। সে তাড়াতাড়ি খালাম্মার কাছে যায়, ফুলেশ্বরীর বইয়ের আলমীরা খোলে। একনজরে দেখে প্রিয়নন্দিনী যাওয়ার সময় তাকে বলেছে,এ আলমীরায় তাকে পাব। ওপরের র্যাকটায় বিছু বইপত্র অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে। তার মধ্যে একটা ডায়েরির মলাটের মতো লাগছে। সেটি বের করল। হ্যাঁ,প্রিয়নন্দিনীর লেখা ডায়েরি।ডায়েরির সাথে আরো কটা বই নিয়ে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে নিজরুমে আসল। দরজাটা বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে বসল। বুকের ভেতর বাজছে কেবলি কোনো আশংকা। তবে কী প্রিয়নন্দিনী ডায়েরিও লিখতো। ধ্রুবকে কোনোদিনও জানায়নি। পাতার পর পাতা ওল্টিয়ে পড়ে যায় ধ্রুব। কখনো তির্যকভাবে কখনো বা সোজাসুজিভাবে লিখেছে।
২.২.২০০৭
ধ্রুব’র নামটা সবার মতো আমিও ডাকতে পারি ধ্রুব বলে। কিন্ত্ত আশ্চর্য হই কীভাবে সবার অলক্ষ্যে আমার হৃদি গগনে আলাদা করে ফেললাম ‘ধ্রুবতারা’ বলে।
৪.২.২০০৭
আমি নিমিষেই স্মরণে আনতে পারি ধ্রুবতারা’র সাথে আমার প্রথম দেখার স্মৃতিটা।আমি মুগ্ধ হই সুদর্শন ও পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের ধ্রুবতারা’কে দেখে।
৫.২.২০০৭
আমার ভেতরের যন্ত্রণার অনুভূতি তাকে দেখবার পর যেমনই হোক না। দরজা খুলবার পর ক্ষণিকের তরে একপলকের দেখা! আমার চোখের পলক সরতে চায়নি। তবে ওর খুব তাড়া থাকায় খালাম্মার সাথে দেখা করে চলে গেল।
৬.২.২০০৭
সেটাতো কেবলি শুরুই ছিল। আমি অবাক হলাম ধীরে ধীরে আমার মনের মাঝে একটা দ্রুত পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। প্রতিদিন একটু একটু করে উদগ্রীব হই ধ্রুবতারাকে দেখবার জন্য। এটাই তবে প্রেম?
৮.৭.২০০৭
ইচ্ছে করে হাতবাড়িয়ে দিই ধ্রুবতারা’র নিবিড় বন্ধুত্বের আহবানে। বলি, তোমাকে চাই, তোমাকে ভালোবাসি।
১০.২.২০০৮
ক্রিকেট খেলার ছলে ধ্রুবতারা যখন আমার পানে হাত বাড়ালো, আমি লাজুক হয়ে গেলাম। বন্ধুত্ব জড়িত ভালোবাসার মাঝে আমি অনিশ্চয়তায় ভোগি।
১১.২ .২০০৮
আমি স্পষ্ট বোঝতে পারছি, কোনো অজানা দুর্বোধ্য ভালোবাসার হাতছানিতে আমি উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি। তবু কোথা জানি একটা আত্নসম্মানবোধে বাঁধে আমায়।
১২.২.২০০৮
ধ্রুবতারা বিশ্বাস করো বা না করো, আমার সহজ স্বীকারোক্তি, আমি তোমায় ভালোবাসি। সেদিন নীল সাগরের তীরে হাঁটছিলাম, ক্ষণে ক্ষণে যেন চঞ্চলতা বাড়ে তোমায় ঘিরে।
আরেক পৃষ্ঠায় তির্যকভাবে লেখা সঙ্গীতের কিছু লাইন; এখানে কোনো তারিখ উল্লেখ নেই।
আমার মনের মোহের মাধুরী/ মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো/ তোমার অঙ্গ সৌরভে/
আমার আকুল জীবন মরণ/ টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো/ তোমার অতুল গৌরবে।
পরের পাতায় লিখেছে-
‘ সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে,
চাঁদের আলোর দেশে গেছে,
হাসি তার রেখে গেছেরে,
মনে হল আখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব,
ভাবতেছি তাই একলা বসে।
১৪.২.২০০৭
পাখি যদি ডাকে প্রতিদিনই ভালোবাসা হয়।তুমি আমার ভালোবাসার পাখি।
২০.৩.২০০৮
আজ বাবা মা দুজনেই ফোনে খুব শাসালো। এখানেও ক্রিকেট খেলা বন্ধ করতে হবে। ধ্রুবতারা আমি তোমার মন নামক ছোট্ট গলিটায় হাঁটছি, বল করছি, ক্যাচ ধরছি। কখনওবা মেঘেদের মতো উড়ে বেড়াচ্ছি। ক্লান্তি আর ঘুমের ঝিমুনি ঝেড়ে। হতাশাগুলোকে এক পাশে সরিয়ে চুপিসারে একাকী হাঁছি। তুমি ভালোবেসে একটু পাশে ডেকে নেবে না আমায়!তোমার ভালোবাসার সব উষ্ণতায় পাগল হয়ে যেতে চাই। কেমন করে তোমায় তা জানাবো!
৩১.৩.২০০৮
খালাম্মা বললেন, ধ্রুবতারার সাথে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ , কথা বলা, দেখা করা সব বন্ধ রাখতে হবে, যদি এখানে পড়তে চাই।ভালোবাসার অনুভূতির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে? থাকে না কোনো কর্তৃত্ব।আমি ধ্রুবতারাকে একইভাবে জীবনজুড়ে, একই তুলিতে একই মনের ক্যানভাসে এঁকে রেখেছি।যদি কোনোদিন এর পরিসমাপ্তি ঘটে, রেখে যাব এতে আমার অজস্র স্মৃতিকথামালা, জানিয়ে দিলাম, তাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষা শতজনমবার।
৫.৮.২০০৮
ধ্রুবতারা শাটলে বসে, লেডিস হলের ঝুপড়িতে চা কলা খেতে খেতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তুমিই তো বলো, তুমি আমারি থাকতে চাও।এই শীতের মৌসুমে আমার না বলা কথা বুঝে নিয়ে আমার ঠাণ্ডা বিবর্ণ হাত দুটি তোমার মুঠোয় পুরিয়ে নাও,দাও, এই হীম হীম রাতে তোমার বুকের সব অনাবিল ওমটুকু।ফুটন্ত অফুটন্ত সব ডিমে তা দিয়ে পাখি যেমনভাবে বুকে জড়িয়ে রাখে তার ডিম আর বাচ্চাগুলোকে। তেমনিভাবে তুমি আমার চঞ্চুতে ঠোঁট রাখ, আমি যে অন্তপ্রাণ ভালোবাসার উড়াল শিখতে চাই তোমার কাছে!
৭.৮.২০০৮
ধ্রুবতারা যেমন করে ঠোঁট থেকে চুমুর ঠোঁট সরে যায়- তেমনি করে তোমার ভালোবাসার নি:শ্বাসের পাশ থেকে আমায় কখনা সরিয়ে দিয়ো না।
৯.৮.২০০৮
তোমার পরানো রিং আমি কখনই খুলবো না। খরতাপে কি আমার প্রেমের বকুলের মালা তার লাবণ্য হারাচ্ছে? তোমার কাছ থেকে সরে এলে আমি যেন সব হারিয়ে ফেলি,কষ্ট পাই। দহন বেলা আমার বাড়তে থাকে।
নীচের দিকে তিতির্যকভাবে ডায়েরির পাতা জুড়ে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত:
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে
জলে স্থলে বাঁজায় বাঁশি।।
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি, আঁখির জলে যায় ভাসি।।
সে সুরে সাগর কূলে বাঁধন কূলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরেবাজে মনে অকারণে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
,ভোলাদিনের কাঁদন হাসি।।
পড়তে পড়তে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে ধ্রুব।ধ্রুব’র জীবনে অপূ্র্ণতা থাকতে পারে না। কারণ একইভাবে প্রথম দেখাতে প্রিয়নন্দিনীও তাকে ভালোবেসেছে। যা সে তার লেখনিতে বার বার উদারভাবে প্রকাশ করেছে। যা মুখে প্রকাশ করতে পারেনি।
ডায়েরিটা কতক্ষণ বুকের মাঝে চেপে ধরে রাখে ধ্রুব।ভালোবাসার এক অদ্ভূত শিহরণে শিহরিত হচ্ছে ধ্রুব। প্রিয়নন্দিনীকে ভালোবাসার বোধ তার সমস্ত তণুমন জুড়ে। প্রথম থেকেই ধ্রুবকে এতটাই ভালোবাসতো প্রিয়নন্দিনী! একবারও জানালে না। একবার চিৎকার করে ধ্রুব’র বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ধ্রুব’র হ্যাঁ, প্রিয়নন্দিনী, আমিও তোমাকে প্রথম দেখাতে ভালোবেসেছিলাম। আজো ভালোবাসি।, জনম জনম ভরে ভালোবাসবো।
প্রিয়নন্দিনী বাড়ি যাওয়ার পর কখনও ধ্রুব আগে ফোন করেনি। যদি সে কোনো বিপদে পড়ে এই ভেবে।ঈদের দিনে সেলিব্রেট করার জন্য সবারে আগে প্রিয়নন্দিনীকেই ধ্রুব ফোন করে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ধ্রুব বলে, প্রিয়নন্দিনী তোমাকে ছাড়া আর কতদিন থাকা যায় বল! প্রিয়নন্দিনী বলেছিল, এই তো এসে যাব ধ্রুব।
এতদিন সব খবরাখবর নদীই দিয়েছে ধ্রুবকে। আর প্রিয়নন্দিনীর সাথে যা কথোপকথন সবটাই খুবই সাবধানে কয়েকটা এসএমএ ‘র মাধ্যমেই গড়িয়েছে । এমনকি ফোনও করা যেত না, যদি বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে এজন্য। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে নি:শব্দে দেখাদেখি হত। ধ্রুব’র এত সতর্কতার একটাই কারণ ছিল, প্রিয়নন্দিনী যেন ভালোয় ভালোয় ছুটির অবকাশ কাটিয়ে বাড়ি ফেরে।
৭
ঈদের ছুটির অবকাশ যাপন শেষ করে সকলে ভার্সিটি যাচ্ছে। প্রিয়নন্দিনী এলো না। ধ্রুব সাহস করে একটা এসএমএস দেয়-‘ প্রিয়নন্দিনী আমি যে তোমার সনে বেঁধে রয়েছি এই মনের ঘর।প্রতিদিন পড়ছি তোমার কালো অক্ষরে হৃদয় ছিদ্র করা ডায়েরির পাতাগুলো। আমরা কেউ আমাদের ভালোবাসার রক্ষা কবচের অমর্যাদা করব না। আমি আমাতে নয় শুধু তোমাতে।তাইতো প্রতিদিন গড়ে একটি করে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি।আজ থেকে তুমি আসতে যতদিন সময় লাগবে, প্লিজ প্রতিদিন আমাকে একটি করে চিঠি লিখো।
সাথে সাথে প্রিয়নন্দিনী রিপ্লাই দিল, ‘আমাদের দীর্ঘসময় না দেখবার যে গভীর বিরহ তা বুঝি। আমি যে চিরকালের তোমার।তোমার সবরকমের মর্যাদা আমি রক্ষা করবো। নইলে যে কষ্টে ,যন্ত্রণায় আমি নীলপদ্ম হয়ে যাব।
তারপর দিন থেকে প্রিয়নন্দিনীর মোবাইল সুইচ অফ। নদীও কিছু বলতে পারল না। বলা হচ্ছে নাম্বারটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ধ্রুবর ঘুম আসে না রাতে। মোবাইলে দেখে প্রিয়নন্দিনীর সাথে তার উঠানো ছবিগুলো। ছবিতে প্রিয়নন্দিনী কখনও খুবই অনুদ্বিগ্ন, কখনও আড়ষ্ট, কখনও মহাআনন্দে উচ্ছ্বসিত, কখনও বা ঘনিষ্টতায় নানান ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলো।ভিডিওর সবছবিতে হাসিমুখের উকিঝুঁকি যেন। একটি ভিডিওতে নীলসমুদ্রের অপার জলরাশির মাঝে একান্ত সান্নিধ্যে দুজনে, কোনটায় ভার্সিটির পাহাড়ী প্রকৃতির নিসর্গ নির্জনতায় দারুণ লাগছে প্রিয়নন্দিনীকে। রক্তরাঙা সন্ধ্যা রবির লাল আভা প্রিয়নন্দিনীর উজ্জ্বল হাসিমুখখানিকে কী অনবদ্য,অপরূপ করে তোলেছে। সে যখন কাছে ছিল, এতটা হাস্যময়ী অম্লান চেহারার প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব যেন কখনই খেয়াল করেনি। যখন যেথায় যেতে চেয়েছে মন, সেথায় গিয়েছে তারা। নদী, পাহাড়, সমুদ্র কোনটিই বাদ যায়নি, এমনকি বাদ যায়নি দুজনের মেঘছুঁয়ে দেখার আজন্ম ইচ্ছেটুকুও যেন। এসব দেখতে দেখতে , অদ্ভুত বেদনার ভাবনার গভীরে কবে যে, দুচোখে তন্দ্রা নেমে এল ধ্রুব বোঝতেই পারেনি।
বিকেলে সেই পরিত্যক্ত ঘরের ছাদের ওপরে ওঠেএল প্রিয়নন্দিনী। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো দেখবে বলে। ধ্রুব, প্রিয়নন্দিনী পাশাপাশি বসল। দূরের আকাশে অনেকগুলো ঘুড়ি, ঘুড়ি আর ঘুড়ি ওড়ছে। তবে কোনো বর্ণিল ঘুড়ি নেই। সবগুলো ঘুড়িই সাদা রঙের।সাথে সাথে একটা ঘুড়ি কাটা পড়ল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ছেলেরা বাহকাট্টা বলে চেঁচিয়ে ওঠে। ধ্রুবর ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড় করে ওঠে গেল। ধ্রুবর গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে।নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে ধ্রুব। এই স্বপ্ন থেকে, সংশয় থেকে সে মুক্তি চায়, স্বস্তি চায়। প্রিয়নন্দিনীকে নিয়ে সে সবুজ শ্যামলিমা মাঠে নীল আকাশে বর্ণিল ঘুড়ি উড়াউড়ি দেখতে চায়। তাদের প্রিয় লাল ,সবুজ রঙের ঘুড়িও উড়তে থাকবে। ট্রাই করে প্রিয়নন্দিনীকে। ফোনে একই ম্যাসেজ আসছে। নাম্বারটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। এসএমএস আনসাকসেসফুল হয়ে ব্যাক করছে। ধ্রুবর ধৈর্য্যে চিড় ধরে আসে। নদীকে কল দেয়। নদী কিছু বলতে পারলো না।প্রিয়নন্দিনীর কথা ভেবে বার বার অজানা আশংকায় কাতর হয়ে পড়ে ধ্রুব।
এদিকে ফুলেশ্বরী আপুদের বাসায় আজো তালা ঝুলানো দেখল।
সপ্তাহ পর দেখা গেল খালাম্মা খালু এসেছে। প্রিয়নন্দিনীর কথা যা শুনলো, মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত পড়ল। তার সুখের নদী নিমিষেই যেন শুকিয়ে গেল। প্রিয়নন্দিনী ঈদের তিনদিন পরই অন্যের বাগদত্তা হয়ে গেছে। প্রবাসী স্বামী, তাকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে।
এসব খবর শুনে বিপন্ন এই সন্ধ্যাটায় ধ্রুব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বুকের অলিন্দে উম্মাদ ঝড়, সহস্রধারায় অশ্রু নেমে আসছে। কোনোমতে, সকলের চোখ এড়িয়ে পরিত্যক্ত বাসার কাঠের সিঁড়িতে যেখানে প্রিয়নন্দিনী তার পথরেখা এঁকে রেখেছে তার স্পর্শ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে ছাদের কোনায় পৌঁছে। চোখের কোণে বার বার জমে আসছে জল। দিগন্তবিস্তারী আকাশটাকে ফাঁকা লাগছে। ধ্রুব অবুজের মতো ঢুকরে ঢুকরে অনেক কাঁদলো। কবে রাত ফুরিয়ে আসছে ধ্রুব বুঝতেই পারলো না। হঠাৎ নজরে পড়ল টর্চ হাতে জ্বালিয়ে একটা লোক সিড়ি বেয়ে ছাদের ওপরে ওঠছে। কাছে আসতেই ধ্রুব দেখল তার বাবা।বাবাকে কাছে পেয়ে ধ্রুব যেন শৈশবের বালক বয়সে ফিরে এলো। নি:শব্দে দাঁড়িয়ে বার বার চোখ মুছে। বাবা পিটে হাত বুলিয়ে দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
-তোর মতো বয়সে আমিও তোর মতই স্বপ্ন দেখেছি, বোঝতে পারছি, সেই স্বপ্নের কাঠামোতে আজ তুই দাঁড়িয়ে। সব স্বপ্নের কী বাস্তবে রূপ মেলে বাবা?
– ধ্রুব নিজেকে সামলে নেয়। বাবাকে বলে, বাবা সবার ভালোবাসা ফিরিয়ে নিলেও তোমার ও মা’র ভালোবাসা কখনই ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আমি তোমাদেরি সন্তান। তোমাদেরি খুব ভালোবাসি। আর কখনও মিছেভরা স্বপ্নগুলো দেখবো না। ধ্রুব বাবার বুকে ছোটবেলার মতো মুখ লুকায়। বাবা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।
রাতের আকাশজুড়ে পূর্ণিমা চাঁদ আর জোছনার প্লাবন। কলোনীর সবুজ মাঠের বিছানায় দু’জোড়া পা চলতে চলতে বাসায় পৌঁছে।বাবার সাথে রাতের হালকা শিশিরের ওপর চলতে গিয়ে মাটির সোঁধা গন্ধটা্ও ভালো লেগে যায় ধ্রুবর। বাবা তার অনুভূতি বোঝতে পেরেছে, তাই মনটা অনেকখানি হালকা হলো।
মা খাবার টেবিলে বসে আছে আবেগের সাথে, ধ্রুব কবে আসবে, কবে ভাত খাবে? দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মা’র প্রেসারটা বেড়েছিল।মা ভাল-মন্দ কোনো প্রশ্ন করলো না। মাও যেন কোনো প্রিয়জনের বিচ্ছেদের মানে জানে। খাবারের দিকে মুখ ফেরাতে পারে না ধ্রুব। বোঝা গেল বাবা মা কেউ এখনও খায়নি। ধ্রুব মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল, একটু মন খারাপ হয়েছিল, তাই দেরি হয়ে গেল।সরি মা, সরি বাবা। বুকের সবকষ্ট বুকে জমিয়ে রেখে এক সাথে চিংড়ির মালাইকারী আর মুগডালের ঘন্ট দিয়ে ভাত খেল তিনজনে মিলে।
প্রিয়নন্দিনীর সে ডায়েরিটা ধ্রুব’র মাথার কাছের বালিশটার নিচেই থাকে। মাঝে মাঝে বেদনার শিয়রে থেকে ডায়েরিটা হাতে নেয়। ধ্রুবর সমস্ত দিনানুদিনের ভিড়ে, চিন্তানুচিন্তন নি:সঙ্গতাকে এই ডায়েরিটাই সঙ্গ দেয়।ডায়েরিটার ওপরেই নির্ভর করেই নির্ভার করে ধ্রুবর অশান্ত মনকে।
খালাম্মা বলতো, প্রিয়নন্দিনীর জামাই কারো সাথে তাকে মিশতে দেয় না।ফোন ব্যবহার করতে দেয় না। বিদেশ গিয়ে একেবারে পাল্টে গেছে।
প্রায় দশ বছর পরে প্রিয়নন্দিনী একাকী বিদেশ থেকে ফিরে আসে। জানতে পেরে খালাম্মা ধ্রুবর মাকে জানাল সে বোনঝিকে দেখতে ছুটছে ভোলা।ধ্রুব খবরটা পাওয়া মাত্রই নদীকে খবর দেয়।নদী অনেক কষ্টে তার বাবার সাথে যোগাযোগ করে প্রিয়নন্দিনীর ফোন নাম্বার জোগাড় করে।ধ্রুব আজো তার জন্য অপেক্ষা করছে জানাল।নদীই প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব’র অফিসের ঠিকানা দিয়েছিল। আর এতো কাছে এলো প্রিয়নন্দিনী! দেখা হলো না, কথা হলো না! এ কষ্ট কেমন করে মনকে বোঝাবে ধ্রুব।
ক’দিন বাদে খালাম্মা ভোলা থেকে এলেন। মুখজুড়ে কালো হতাশার মেঘ যেন। বার বার কান্নাজড়িত ভারিকন্ঠে বলছিলেন, প্রিয়নন্দিনী মোটেই ভালো নেই। তার স্বামী তাকে বিদেশ নিযে গিয়ে তার সাথে অসংলগ্ন কথাবার্তা,অস্বাভাবিক হিংসাত্নক,প্রতারণামূলক আচরণ করতে শুরু করে।প্রতিরাতে তাকে শারীরিকভাবেও অত্যাচার করত। তাকে সবসময় বাসায় একাকী তালা মেরে রাখতো। সে কোনোদিন দিনের আলো পর্যন্ত দেখেনি। তার স্বামী একটা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত ব্যক্তি। এসব প্রকাশ পাবে বলে, সে বিয়ের পর থেকে কখনো প্রিয়নন্দিনীকে কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে দেয়নি। মাঝে মাঝে ফোনে তাকে শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো বলতে বাধ্য করা হতো। কথায় কথায় বলতো, কিসের বউ? তাকে তো বিক্রির জন্যই এত টাকা খরচা করে বিদেশ এনেছে। বিয়ে ছিল পুরো একটা সাজানো নাটক। প্রিয়নন্দিনী কোনো প্রতিবাদ করতে চাইলে বলতো, তুমি এখনো আমার বিয়ে করা বউ। আমার যা খুশি তাই করতে পারবো। তাকে অত্যাচার করতে করতে একসময় একটি পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়। আর কোনোদিন সে স্বামীকে দেখেনি। শুধু ফোনে তাকে ডিভোর্স দিয়েছে বলে জানায়।সেখানে প্রিয়নন্দিনীসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত নারীকে এনে আটকে রাখা হয়।অত্যাচার করা হয়। সেখানে প্রিয়নন্দিনী আটককারী নারীদের লিডার হয়ে ওঠে। আসলে সবটাই ছিল তার ছলনা,অভিনয়। কিভাবে অন্য মেয়েরা সে বন্দীদশা থেকে মুক্তির উপায় বের করতে পারে এজন্য। সেখানে সে সবসময় বন্দী ও কঠিন পাহারারত অবস্থায় কাটিয়েছে। অনেকের সাথে একদিন রাতে সেখান থেকে বিদ্রোহ করে তালা ভেঙ্গে বন্দীঅবস্থা থেকে তারা যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে নিজেদের আত্নরক্ষা করার চেষ্টা করেছে। হয়ত কেউ কেউ ধরা পড়েছে। জীবনের জন্য অমানবিক নির্যাতন তাদের জন্য অবধারিত হয়ে গেল। সে গিয়ে পড়ল ইন্ডিয়ান এক লোকের কাছে।তাকে সে বোনের মর্যাদা দিয়েছে। তাকে সে লোক ২ বছর এখানে সেখানে লুকিয়ে রাখে। সে অসুস্থ ছিল। তাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করল। কাগজপত্র, ঠিকানা সব জোগাড় করে, নতুন করে পাসপোর্ট করে তাকে দেশে পাঠায়।
মা-বাবার প্রচণ্ড চাপে ও ভয়ে বিত্তশালী ভালো পাত্রের সাথে বিয়েতে সম্মতি দিতে বাধ্য হয়েছিল প্রিয়নন্দিনী। দুর্ভাগ্য, যার হাত ধরে জীবনের যাত্রা শুরু করেছিল, সে জীবনে লাঞ্চনা ছাড়া সে কিছুই পায়নি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সে নি:সঙ্গ, অমানবিক একটি সংসার পেয়েছিল। সে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থেকেছে। সমস্যা সমাধানের সামান্যতম অনুভূতি বা সাহায্য তখন পায়নি।
ধ্রুবর ইচ্ছে করে, জীবন ঘড়ির পেন্ডুলামটা আবোরো ঘুরিয়ে দশবছর আগের জীবনে পিছিয়ে দেয়। প্রিয়নন্দিনীর ওপর তার যত রাগ,ক্ষোভ, হতাশা,মান- অভিমান, সংশয়-দ্বন্দ্ব ছিল সবটাই সূর্যের তাপে মোমগলা তরল বস্তুর মতো হয়ে যায়।ধ্রুব আপন মনে ভাবে, যা ঘটেছে তাতে প্রিয়নন্দিনীর কোনো হাত নেই, তার কোনো দোষ নেই। নি:সন্দেহে সে অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। ঘোরতর কঠিন বিপর্যয়কর বিপদের মধ্যে ছিল সে। ধ্রুব’র জন্যই প্রিয়নন্দিনী হয়ত প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। এটাই শোকরিয়া। প্রিয়নন্দিনী তার পরিবারের চাপে যদি অপরাধও করে সবকিছু মার্জনা করে তার পূর্ব প্রেমের মর্যাদা দেবে ধ্রুব।আজো সে প্রিয়নন্দিনীকে ভুলতে পারেনি বলে বিয়ে করেনি।
প্রিয়নন্দিনীর মা-বাবা ভেবেছিলেন, মেয়েকে যার হাতে পাত্রস্থ করেছে সে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি দেবে। যখন তখন দেশ বিদেশ ভ্রমণ করবে। জীবনযাত্রার অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বাড়াবাড়ি থাকবে। দেখলে যেন সবার ঘোর লেগে যায়। বাস্তবে তার হিতে বিপরীত হলো।
৮
খালাম্মার কাছ থেকে ভোলার প্রিয়নন্দিনীর বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে। পরদিন সন্ধ্যায় নদীকে সাথে নিয়ে ধ্রুব প্রিয়নন্দিনী ভোলা রওয়ানা হয়। সকালে তারা প্রিয়নন্দিনীর বাড়ি পৌঁছে যায়। ধ্রুব, নদী কেউ জানতো না এতবড় সর্বনাশা পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।বাড়ির কাছে আসতেই একটি লাশের খাটিয়ার ওপর স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ হয়।তারা কণ্ঠহারা হয়ে যায় যেন। একটা লোক সবাইকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে, কান্না করছে। বলছে,মা আমার অভিমান করে চলে গেলি!প্রতিবেশিদের কথায় জানা গেল, কাল রাতে মা-বাবা’র সাথে প্রিয়নন্দিনীর খুব কথা কাটাকাটি শুনেছে। কারণ প্রিয়নন্দিনীর অসম্মতিতে এ বিয়ে হয়েছিল।যদি এ বিয়ে না করে তবে তার বাবা বিষ খাবে বলেছিল। প্রিয়নন্দিনীর জীবন থেকে দশটা সোনালী বছর হারিয়ে গেল। তার জীবনের এ করুণ অধ্যায় নিয়ে কাল রাতেও তর্কাতর্কি হচ্ছিল তার বাবা তখন বলছিল, তখাকথিত জামাই’র বিরুদ্ধে তিনি মামলা করবেন। প্রিয়নন্দিনী এতে সায় দেয়নি। বলেছিল, এসব ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের কথা , দুর্ভাগ্যজনিত পরিস্থিতির কথা সে আর কাউকে মুখ খুলে জানাতে পারবে না। সে জানে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ কিছু করতে গেলেই এ অন্ধকার সমাজে সে নতুন করে কলংকিত,খারাপ নারী হিসেবে আখ্যা পাবে। হয়ত রাতে এসব দুঃসহ কষ্টের , অত্যাচারের স্মৃতি ভাবতে গিয়ে লজ্জায়, অপমানে রাতে ঘুমের ভেতর প্রিয়নন্দিনী হার্টস্ট্রোক করে সবার সাথে অভিমান করে চলে গেল।
ধ্রুব গভীরভাবে শোকাহত ও স্তম্ভিত হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। নদী ধ্রুবকে নিয়ে আত্নীয় স্বজন, পড়শীদের ভিড় ঠেলে একবার প্রিয়নন্দিনীর মুখটা দেখবার ব্যবস্থা করে।প্রিয়নন্দিনীর হাতে ধ্রুব’র দেওয়া রিংটা আজো রয়ে গেছে।রিংটা মনে করিয়ে দেয়, প্রিয়নন্দিনী একটা মুহুর্তের জন্য ধ্রুবকে ভুলতে পারেনি।
ইতিমধ্যে খালাম্মা, খালু এসে পড়েছেন।
ধ্রুব’র সাথেও পার্থিব সম্পর্কের অবসান ঘটাল অভিমানী প্রিয়নন্দিনী। তার চিঠির উত্তর ধ্রুব দিতে পারেনি। বিয়ের পর থেকে তার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পর্যন্ত হলো না। বিধির বিধান! দশবছর পরে ধ্রুবর অফিসে গিয়েও সাক্ষাৎ মিললো না। ধ্রুবও চায়, সবভুলে প্রিয়নন্দিনী তার হোক। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিধিলিপির বৈপরিত্যের কারণে ধ্রুব ও প্রিয়নন্দিনীর দুটি মনের মিলন কোনোদিনও হতে পারলো না। আর এ জীবনে কোনোদিন হবে না।
ধ্রুব অন্যদের অনুসরণ করে প্রিয়নন্দিনীর লাশের খাটিয়াটি নিজের কাঁধে তুলে নেন। কলেমা পড়তে পড়তে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় গোরস্থানের দিকে। মনের মাঝে বাজতে থাকে এ জীবনে তোমাকে পেলাম না প্রিয়নন্দিনী! শেষযাত্রায় হলেও আমার কাঁধে চড়ে যাও। কত ভারি এই দায় তুমি তো জান না। তোমার আমার প্রেমের, ভালোবাসার মর্যাদা হানি হতে দিইনি। এতোকাল অপেক্ষা করেছি। তোমার কথা রেখেছি, তোমার পরানো শিউলি ফুলের মালাটা আজো তুলে রেখেছি যত্ন করে। আজ অন্তত তোমার ভালোবাসার ঋণ পরিশোধের সামান্যতম সুযোগতো পেলাম। কত প্রেমিক তা-ও পায় না।
প্রিয়নন্দিনীর তার সম্ভ্রম হারাবার যন্ত্রণা ভুলে অসংখ্য কষ্ট, লোমহর্ষক নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে ধ্রুবর সুখ স্মৃতিগুলোকে মনে রেখেছে। তার ঠিকানায় তার কাছে ছুটে গেছে। এজন্যই তার মায়ার টান, ভালোবাসার টান কখনই ধ্রুব উপেক্ষা করবে না। সবাই গোরস্থান থেকে একে একে চলে যায়, ধ্রুব প্রিয়নন্দিনীর কবরের ওপর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে প্রতিজ্ঞা করে, আজ থেকে সে কাজ করবে,এভাবে নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে আর কোনো প্রিয়নন্দিনীকে সুন্দর জীবনের সহিংস বলিদান হতে না হয়। প্রিয়নন্দিনীর হত্যার প্রতিশোধ সে নেবেই। এজন্য আজকে থেকে আরেক মরুতৃষ্ণা জমেছে ধ্রুবর মরু হাহাকার বুকে।
প্রিয়নন্দিনীর শত শত মুখ যেন ধ্রুবর সামনে এসে দাঁড়ায়। ধ্রুব নারী পাচারের বিরুদ্ধে প্রিয়নন্দিনীর দাবী দাওয়াসমূহ নিয়ে মিছিলে নেমেছে।ব্যানার, ফ্যাস্টুন হাতে শত শত নির্যাতিত নারী। নাগরিক রাজপথ, অলিগলি সব ভরে দিচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছে। সাংবাদিকেরা ছবি নিতে ছোটাছুটি করছে। নাগরিক সমাজের একটি দল নারী ও শিশু অধিদপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করছে। প্রিয়নন্দিনীর মতো হাজারো নারীর আর্তনাদ, হাহাকার… চাকরির লোভে, বিয়ের নামে তারা জীবনের বলি হতে চায় না।আর কতোকাল তারা অবিচারের, প্রতারণার বলি হবে!তারা ‘ফিরে যেতে চায় নিরাপদ জীবনে। তারা ‘প্রিয়নন্দিনীর অকাল মৃত্যুর বিচার চাই’ খুনি দালাল হাশেমের ফাঁসি চাই’।প্রিয়নন্দিনীকে ধ্রুব’র পাশে দেখতে পেয়ে তাকে ডাকতে থাকে প্রিয়নন্দিনী!প্রিয়নন্দিনী! ছুঁতে যায় প্রিয়নন্দিনীকে। অমনি ধ্রুব চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়।মিছিলের শ্লোগানের আওয়াজ এখনও কানে বাজছে ধ্রুব’র। এ কোন দহন বেলা। ঘড়ি দেখে ধ্রুব। বোঝতে পারলো, এতক্ষণ যা দেখেছে, সে স্বপ্নে দেখেছে। বুকটা ধড়ফড় করছিলো। টেবিলে রাখা পানির শিশি থেকে সব পানি-ই খেয়ে ফেললো।
প্রিয়নন্দিনী ভাবতো,ধ্রুবর জীবনসঙ্গিনী হয়ে আসবে।ধ্রুবও অপেক্ষার প্রহর গুণেছে। প্রিয়নন্দিনী ফিরে আসবে তার দাম্পত্য সাথী হবে। কিন্তু কারো ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ধ্রুব মাথার কাছে বালিশের নিচ থেকে ডায়েরির শেষ পাতা পড়ে, প্রিয়নন্দিনী লিখেছে, ‘‘ মানুষ যা ইচ্ছে করতে পারে, কিন্ত্ত মানুষ কী ইচ্ছে করবে, তা ইচ্ছেমতো স্থির করতে পারে না।’’-সোপেন হাওয়ার।
ধ্রুব উপলদ্ধি করে, আসলে কথাটা যথার্থই বটে।
লেখক- উন্নয়ন সংগঠক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক।