রাও ফরমান আলীর ভূত

0

 

facebook sharing button
twitter sharing button
সব্যসাচী টিটু : ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। শীত জাঁকিয়ে বসেছে। আর্মি সদর দফতরের পূবের বারান্দায় বসে, কুয়াশা ভেজা সকালে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ডিউটি অফিসারকে জরুরি তলব করলেন প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

অফিসারকে কড়া নির্দেশ দিলেন দুপুরের মধ্যে রাজাকার, আলবদর, আলশামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের নিয়ে একটি জরুরি গোপন বৈঠকের আয়োজন করতে। ডিউটি অফিসার বেড়িয়ে গেলে ফরমান আলী আকাশের দিকে চেয়ে থাকলেন। একটু একটু করে সূর্যের তেজ বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে ফরমান আলীর প্রতিশোধের স্পৃহা।

নরম আলোর শান্ত সূর্যটা মূহুর্তেই কেমন তেজোদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে, ঠিক যেমন ফরমান আলীর মস্তিকে রাগ,ক্ষোভ আর প্রতিশোধের এক জলন্ত স্রোতধারা বয়ে চলেছে টেকনাফ থেকে মহানন্দা অব্দি।

পরের গল্পটা আমাদের সবারই জানা। ১২ই ডিসেম্বরের পরিকল্পনার সিংহভাগ অর্জন হয় পূর্ব বঙের বিজয়ের প্রাক্কালে। এই বৈঠকে চূড়ান্ত তালিকা তুলে দেওয়া হয়। প্রণয়ন করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা। এই হত্যাকাণ্ড যে সংঘটিত হবে অনেক আগে থেকেই তার নীলনকশা চলছিল।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে এদিনই চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করে পাকবাহিনী। তাদের অস্ত্র নিয়ে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামে আলবদর, আলশামস বাহিনী। বাংলার বেশীরভাগ সূর্য সন্তানদের ধরে নিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় একাত্তরের এই দিনে। মিরপুর, রায়ের বাজারে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাযজ্ঞ বাস্তবায়িত হয় কিছু মেধাহীন বাঙালির হাতে।

যে সমস্ত বাঙালি হত্যাকারীদের বেশীরভাগেরই নাম হারিয়ে গেছে  রাজাকার, আলবদর বা আল শামস নামক সংগঠনের এক পৈশাচিক চেতনার আড়ালে। বহু রক্তগঙ্গা বিধৌত এই বাংলায় রচিত মহাকাব্যের পরতে পরতে লিখা হয় এক ইতিহাসের, যে ইতিহাস কালো কালি দিয়ে লেখা ইতিহাস। যে ইতিহাস ১৪ই ডিসেম্বরের ইতিহাস। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এই দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। দেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল সেদিন সেই মেধার শূন্যতা পূরণ হয়নি আজো।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। যদিও ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল।

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও একই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়েছে।  এরপর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।

কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত করা।

যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, হবিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. আবুল কালাম আজাদ। সাংবাদিক ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), সৈয়দ নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীন। এছাড়া শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মেহেরুন্নেসা, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহাসহ আরো অসংখ্য নাম।

কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ উদযাপন করতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। বিজয়ের ৪৯ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রাও ফরমান আলীর চিন্তা, চেতনা, কিংবা পৈশাচিকতার বীজ আজো রয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। ফরমান আলীর একটা জাতিকে মেধাশূন্য করার মহাপরিকল্পনার ধারা আজো বহমান। বাস্তবায়নের কৌশলে এসেছে পরিবর্তন যা সম্পাদিত হচ্ছে নানা ভাবে, নানা মাধ্যমে নানান উপায়ে।

এখনো এদেশে ধর্মের দোহায় দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয় বাকস্বাধীনতা, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কে। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় ইচ্ছামতো। জ্ঞান নির্ভর শিক্ষার চর্চাকে করা হচ্ছে কোনঠাসা। নেই মানবিকতা, মূল্যবোধের উন্নয়ন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছেঁয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুতেই অবনমন। মেধা ও মননে পিছিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। এমন কি বাংলাদেশ চেয়েছিল শহীদেরা? বিজয়ের ৪৯ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের আত্মত্যাগের মূল্য কবে দিতে পারবো আমরা? কবে পারবো একটি অসাম্প্রদায়িক শ্রেণীহীন সমাজ তথা রাস্ট্র গঠন করতে? কবে পারবো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি স্বনির্ভর দেশ গড়তে, কবে পারবো মেধার সুস্থ্য চর্চা ও তার মূল্যায়ন করতে? ফরমান আলীরা ভূত হয়ে বাস করছে আমাদের এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

যারা চায় এই জাতিকে মেধাশুন্য করতে, যারা চায় সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাস্ট্রে পরিনত করতে। বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে এসে আমরা চাই না ফরমান আলীর ভুতেরা আবার মেধাহীন করুক আমাদের জাতিকে, পিছিয়ে নিয়ে যাক অন্ধকারের দিকে। আমরা আলোর পথযাত্রী, যে আলোর পথ নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা।

Share.

Leave A Reply