চিটাগাং ভয়েস ডেস্ক:পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছে নগরীর চকবাজার মোড়ের সিটি হেলথ ক্লিনিক। সেখানে কোন চিকিৎসক কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সও ছিল না। ছিল না সরকারি নিবন্ধন ও অনুষাঙ্গিক কাগজপত্র। বছরের পর বছর ধরে সেখানে অবৈধ গর্ভপাতের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চলছিল। অন্যদিকে, ক্লিনিকের মালিক হারুনুর রশিদ এইচএসসি পাশ। তিনি নিজেই সার্জিক্যাল কাজটি করতেন। খুব বেশি সমস্যা হলে পাশে থাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা কোন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে একজন নার্স ডেকে অপারেশনের কাজ করতেন। ১৯৮৬ সাল থেকে সেখানে অবৈধ কাজ চললেও রহস্যজনক কারণে কখনো কারো নজরে পড়েনি কিংবা নজরে আনেনি। চলতি বছরের ১৫ মে রিফাত সুলতানা নামে এক তরুণীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের তদন্তে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বের হয়ে আসে। অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে টানা দুইদিন রক্তপাতের কারণে রিফাত নামের ওই তরুণীর মৃত্যু হয়। কিন্তু ক্লিনিক মালিক হারুন এই মৃত্যুকে করোনায় মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
চকবাজারের স্থানীয় লোকজন জানান, ১৯৮৬ সাল থেকে ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন খাজা রোডের বাসিন্দা মোহাম্মদ হারুন। সে ডাক্তার নয়। বুধবার রাতে সিভিল সার্জন ক্লিনিকটি বন্ধ করে দিলে হারুনের কুকীর্তি ফাঁস হয়। গ্রেপ্তার করা হয় হারুনসহ পাঁচজনকে।
ঘটনা যেভাবে জানাজানি হয় : নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মেহেদী হাসান জানান, গত ১৫ মে চকবাজার সিটি হেলথ ক্লিনিকে চান্দগাঁও হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের বিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্রী রিফাত সুলতানার মৃত্যু হয়। রিফাত লেখাপাড়ার পাশাপাশি আগ্রাবাদ গ্লোবাল ডাটা এন্ট্রি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার তিন নম্বর সড়কের লায়লা হাউজের নীচতলায় বোনের সাথে থাকত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই তরুণী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে পরিবারকে লাশ বুঝিয়ে দেয়। এর ১০ দিন পর ২৬ মে ওই তরুণীর বাবা চকবাজার থানায় এসে অভিযোগ করে জানান, তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় সেজান নামে তরুণীর এক বন্ধু এবং অন্য এক যুবককে আসামি করা হয়।
মেহেদী হাসান জানান, মামলার পর সেজানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায় ওই তরুণীর গর্ভপাত করানোর জন্য সিটি হেলথ ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেখানেই সে মারা যায়। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে অস্বীকার করে তারা জানান, হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি। আটক সেজান ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। মামলার পর ওই তরুণীর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়না-তদন্ত ও পরীক্ষার জন্য ডিএনএ নমুনা নেয়া হয়। পাশাপাশি ওই তরুণীর লাশ নিয়ে যাওয়া এম্বুলেন্সটি খুঁজতে থাকে পুলিশ। গত জুন মাসের মাঝামাঝি ওই এম্বুলেন্সের সন্ধান পেয়ে চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেও সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে। এরমধ্যে গত ২৫ অক্টোবর ডিএনএ প্রতিবেদন আসলে পুলিশ নিশ্চিত হয় তরুণীর সাথে কেউ শারীরিক মেলামেশা করেছে।
জবানবন্দিতে নার্স অলকার বর্ণনায় তরুণীর মৃত্যু : হাসপাতালেই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে সেটি নিশ্চিত হয়ে গত বুধবার অলকা পাল (৩২) নামে হাসপাতালের এক নার্সকে আটক করা হয়। অলকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহানের আদালতে রিফাত সুলতানার মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে।
৩২ বছর বয়সী অলকা পাল বলেন, তার বাড়ি কুতুবদিয়া। সাত বছর ধরে সিটি হেলথ ক্লিনিকে চাকরি করছেন। তবে নার্স হিসাবে তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। সিটি হেলথ ক্লিনিকে কাজ করতে করতে নার্সিংয়ে পারদর্শী হয়। গত ১৪ মে সকাল আনুমানিক ১১টায় সিটি হেলথ ক্লিনিকের পাশে মাহফুজুর রহমান ল্যাবে কর্মরত একটি বড়–য়া মেয়ের মাধ্যমে একটি ছেলে ও রিফাত নামে মেয়েটি আসে। ক্লিনিকের মালিক হারুন চম্পা বেগম নামে একজন নার্সকে ফোন করে নিয়ে আসে। চম্পা চুক্তিভিত্তিক গর্ভপাতের কাজ করেন এ ক্লিনিকে।
অলকা বলেন, নার্স চম্পা ক্লিনিকের মালিক হারুনের সাথে কথা বলে রিফাতকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাবার পর তার যৌনাঙ্গে একটি ট্যাবলেট দেয় চম্পা। কিছুক্ষণ পর রিফাতকে ক্লিনিকের চার নম্বর বেডে রেখে চম্পা চলে যায়। কোভিডের কারণে ক্লিনিকে কোন রোগী ছিল না। ওইদিন (১৪ মে) রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটায় রিফাতের প্রচ- ব্যথা উঠে। বিষয়টি জানার পর হারুন ফের নার্স চম্পাকে ডেকে নিয়ে আসে। তাকে একটি স্যালাইন লাগানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাত একটার দিকে রিফাতকে আবারো অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর তাকে বেডে রেখে চম্পা ও হারুন বাসায় চলে যায়। রাতে ব্যাথা বাড়ায় বিষয়টি জানানো হলে হারুন জানান, মেয়েটি নার্ভাস কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।
অলকা বলেন, পরের দিন ১৫ মে দুপুরে রিফাতের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। নার্স চম্পা এসে আবারো দেখে যায়। বিকেল পাঁচটার দিকে রিফাত মারা গেলে তার মা বাবাকে খবর দেয়া হয়। তারা এম্বুলেন্সে করে রিফাতের মৃতদেহ রাঙ্গুনিয়া গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়।
চকবাজার থানার ওসি রুহুল আমীন জানান, রিফাত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ক্লিনিকের মালিক হারুনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আদালত জবানবন্দি দিয়েছে।
সিভিল সার্জন যা বললেন : সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চকবাজারের সিটি হেলথ নামে ওই ক্লিনিকের কোন নিবন্ধন কিংবা বৈধ কাগজপত্র পাইনি। কয়েকজন ডিপ্লোমা নার্সের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে সেখানে কোন নার্স নেই।
সিভিল সার্জন বলেন, নগরী কিংবা জেলায় কি পরিমাণ ক্লিনিক রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোন তালিকা আমি পাইনি। গত আগস্ট মাস থেকে ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল নিবন্ধনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের কাছে ৫৮০টি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এর বাইরে যেগুলো রয়েছে তা অবৈধ।
অবৈধভাবে প্রায় ৩৪ বছর ধরে নগরীর চকবাজারের মতো স্থানে সিটি হেলথ ক্লিনিক কিভাবে চলছিলো, তা জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, আমাদের জনবলে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নগরীর কোন্ ওয়ার্ডে কয়টি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক রয়েছে তা জানতে আমরা সিটি কর্পোরেশনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি।