তাদের নানা অপকর্মে সাহস জোগান গডফাদার নামে পরিচিত বড় ভাইয়েরা। এসব বড় ভাই চট্টগ্রাম নগর যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পদধারী, নামধারী। অনুসন্ধান ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগরে ৪৭ বড় ভাইয়ের দলে রয়েছে ৬০০ কিশোর-তরুণ। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে বড় ভাইয়েরা এদের টানছেন। কিশোর থেকে শুরু থেকে তরুণেরা নানা মোহে পড়ে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকেরা।
পুলিশ বলছে, তাদের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪ মাসে ৩৬টি গুরুতর অপরাধের ঘটনায় কিশোর-তরুণেরা জড়িত। এর মধে৵ খুনের ঘটনা ঘটে ২৪টি। সব ঘটনার নেপথে৵ আছেন বড় ভাইয়েরা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে নগর পুলিশ কিশোর গ্যাং ও তাদের পৃষ্ঠপোষক বড় ভাইদের একটি তালিকা করেছে। এই তালিকা ধরে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। তবে গত সেপ্টেম্বরে নগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের যোগদানের পর তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।
যেভাবে বড় ভাইদের কবজায়
কেউ ঠেকায় পড়ে, কেউ সঙ্গদোষে আটকা পড়ছে বড় ভাইদের জালে। গত বছরের ২৬ আগস্ট খুন হয় দশম শ্রেণির ছাত্র জাকির হোসেন (সানি)। সে চট্টগ্রামে বোনের বাসায় থাকত। তার দুলাভাই চট্টগ্রাম পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা। জাকির হত্যা মামলার আসামি ফয়সাল আলম গত ২৮ আগস্ট আদালতে জবানবন্দিতে বলেছে, এমইএস কলেজের জিএস আরশেদুল আলম ওরফে বাচ্চুর অনুসারী তাঁরা। কলেজে বড় ভাই আনিসের সঙ্গে বেয়াদবি করায় জাকিরকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়।
মামলার বাদী ও নিহত জাকিরের বড় বোন মাহফুজা আক্তার বলেন, এমইএস কলেজ জিএস আরশেদুল আলম, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরসহ ৫১ জনের নাম মামলার এজাহারে নতুন করে যুক্ত করার জন্য ঘটনার এক মাস পর আবেদন করলে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
৪৭ ‘বড় ভাইয়ের’ দলে ৬০০ সদস্য
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিন বড় ভাইসহ নগরে ৪৭ বড় ভাইয়ের দলে ৬০০ সদস্য রয়েছে। নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের চার থানায় গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ১৬ আর সদস্যসংখ্যা ৩৫০। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর অপরাধীর সংখ্যা কোতোয়ালি থানা এলাকা, এখানে সদস্যসংখ্যা ১৫০ ও গ্রুপের সংখ্যা ৪। বাকলিয়া থানা এলাকায় গ্রুপের সংখ্যা তিন আর সদস্যসংখ্যা ১৮। চকবাজারে গ্রুপের সংখ্যা ৭ ও সদস্যসংখ্যা ১৫২। সদরঘাট থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২ ও সদস্যসংখ্যা ৩০। একইভাবে উত্তর বিভাগের ৪ থানায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ১৫ ও সদস্যসংখ্যা ৮৮। সব মিলিয়ে নগরের ১৬ থানায় ৬০০ সদস্য সক্রিয় রয়েছে গডফাদারদের প্রশ্রয়ে।
গণি বেকারি মোড়, চকবাজার, লালখান বাজারসহ ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে কিশোর গ্যাং। বছরখানেক আগে আড্ডার দেড় শতাধিক স্পট চিহ্নিত করে পুলিশ।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জানান, সন্ধ্যার পর উপযুক্ত কারণ ছাড়া স্কুলপড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী কিংবা কিশোরকে আড্ডায় পেলে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হচ্ছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এ রকম অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
বড় ভাইয়ের অস্ত্রে স্কুলছাত্র খুন
চকবাজার থানা এলাকায় বড় ভাইদের একজন চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রউফ। তাঁর নেতৃত্বে চকবাজার, জামালখান, গণি বেকারি, চন্দনপুরা ও রহমতগঞ্জ এলাকায় সক্রিয় রয়েছে কিশোর গ্যাং। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে জামালখান মোড়ে স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে খুন করে কয়েক কিশোর। দুদিন পর গ্রেপ্তার হয় পাঁচ কিশোর। তারা জবানবন্দিতে বলে, এনাম হোসেন নামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা তাদের অস্ত্রটি দিয়েছিলেন। এই এনাম আবদুর রউফের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ঘটনার পর থেকে এনাম পলাতক। এখনো পিস্তলটি উদ্ধার করা যায়নি। তবে আবদুর রউফ তাঁর সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।
আদনান খুনের পর সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর রউফের দুই অনুসারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন আবদুল্লাহ আবু সাঈদ (২০) ও এখলাস উদ্দিন (২১)।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মুহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, জামিন পাওয়ার পরও তারা নিজেদের সংশোধন করতে পারেনি। কিশোর বয়সে যারা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকদের সচেতন থাকার অনুরোধ করেন তিনি।
কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে যারা
র্যাবের হাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নামধারী নূর মোস্তফা ওরফে টিনুর গ্রুপ বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ ও চকবাজার এলাকায় সক্রিয়। ওই বছরের ৬ এপ্রিল এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার জেরে কিশোরদের দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া হয়। বিরোধ মেটাতে গেলে মনিহারি ব্যবসায়ী লোকমান রনি বাকলিয়া এলাকায় যুবলীগ নামধারী সাইফুল ইসলামের গুলিতে নিহত হন। দুদিন পর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সাইফুল। তিনি মোস্তফার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
মোস্তফা কারাগারে থাকলেও তাঁর গ্যাং দেখভাল করছেন তাঁর ভাই নুরুল আলম ওরফে শিপু ও কাপাসগোলার সাদ্দাম হোসেন ওরফে ইভান। দুজনের বিরুদ্ধে ১০টি করে মামলা রয়েছে। নুরুল আলম নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, রাজনীতি করার কারণে মামলার আসামি হয়েছেন। বছরখানেক আগে ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।
লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম, সদস্য এ এফ কবির মানিক ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত বেলালের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। আবুল হাসনাত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কলেজছাত্র দিদার হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম বাদ দেয় পুলিশ। এই হত্যা মামলায় ১৪ কিশোর জড়িত থাকার তথ্য পায় পুলিশ, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭। আর দিদারুল ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি। এই তিনজনের নেতৃত্বে সেখানে শতাধিক উঠতি সন্ত্রাসী সক্রিয়।
জানতে চাইলে দিদারুল, কবির ও হাসনাত দাবি করেন, রাজনীতি করার কারণে তাদের সভা-মিছিলে অনেকেই আসে। তবে কোনো কিশোরকে তাঁরা দলে রাখেন না।
যুবলীগ নামধারী এসরারুল হকের নেতৃত্বে একাধিক গ্রুপ নগরের বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, শমশেরপাড়া, কালুরঘাট ও পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয়। নগরের মুরাদপুর, নাসিরাবাদ পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয় মো. ফিরোজের দল। দুই নম্বর গেট, জিইসি, জাকির হোসেন রোড, আল ফালাহ গলি ও নাসিরাবাদ এলাকায় সক্রিয় যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশা গ্রুপ। নগরের ব্যাটারি গলি এলাকায় রয়েছে যুবলীগ নামধারী মহিউদ্দিন তুষারের গ্রুপ।
নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় যুবলীগ নামধারী মোস্তফা কামাল, নাহিদুর রহমান, জহির উদ্দিন ও পারভেজের কিশোর গ্রুপ রয়েছে। তবে তাঁরা তা অস্বীকার করেন।
নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম বলেন, দলের ভেতর কেউ অপরাধে জড়িত থাকলে ছাড় পাবে না।
৩ মাসে গ্রেপ্তার ৬০
গত আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে কিশোর গ্যাংয়ের নেতাসহ ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-পুলিশ। সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর লালখান বাজার এলাকার শরীফ ওরফে ডেকসি শরীফকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাট এলাকা থেকে বাদশা ওরফে হামকা রাজুকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। যুবলীগ নামধারী দুজনই কিশোর গ্যাং গডফাদার। মামলা রয়েছে সাতটি করে। কারাগারে ইটের আঘাতে গত বছরের ২৯ মে মারা যান যুবলীগ নামধারী কিশোর গ্যাং নেতা অমিত মুহুরী। ৩১ অক্টোবর বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ডবলমুরিংয়ের খোরশেদ আলম।
কিশোর, তরুণদের অপরাধে জড়ানো গডফাদাররা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, বিন্দুমাত্র ছাড় নেই বলে জানান পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি বলেন, তবে পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের সচেতনদের এগিয়ে আসতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সাতটি ট্রাইব্যুনালে শিশু আদালত হিসেবে বিচার কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে ১ হাজার ৮৮টি মামলা বিচারাধীন। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও অস্ত্র আইনে এসব মামলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-৬-এর সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম বলেন, বেশির ভাগ মামলা খুন, মাদকের। আসামিদের বয়স ১০ থেকে ১৭।
করণীয় কী
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়ায় কিশোরেরা আদর্শহীনভাবে বেড়ে উঠছে, এমনটা মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই সে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু-কিশোর যারা আছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য যারা কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছে, তারা যে দলেরই হোক, এখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে সবাইকে খেসারত দিতে হবে।