মোহাম্মদ খোরশেদ আলম | বিজয়ের মাসেই চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম ও মৃত্যু। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে তাঁর জন্ম। আর মৃত্যু ১৫ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন ’৬০ দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা। ’৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ’৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা আন্দোলন ও ’৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
’৬৮ সালে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিবাচিত হন তিনি। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন আরেক কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ। ’৭০-এর নির্বাচনে রাউজানে নৌকার মাঝি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের পক্ষে গণজোয়ারের ঢেউ তুলেছিলেন তিনি। সম্পৃক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ যুবলীগ, ছাত্রলীগ, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ।
’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে জয়বাংলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি, এই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন শহিদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ।
মহান মক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন। একইসাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন চট্টগ্রাম ৮ আসনের সংসদ সদস্য, দক্ষিণজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি তৎকালীন ছত্রলীগনেতা মোছলেম উদ্দীন আহমদ। পাগলের বেশধরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
মহিউদ্দীন ভাইকে আমি প্রথম দেখি ১৯৮১ সালে ১৫ নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের নির্বাচনী প্রচারণা সভায়। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন এডভোকেট আব্দুস সাত্তার। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় ছিল মোমিনরোডস্থ হাজী আমীর আলী বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর (বর্তমান ইলিয়াস ব্রাদার্স’র বিল্ডিং)।
কার্যালয়ে প্রধান দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা হাসান মাহমুদ শমসের। সেই সময় মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ ইউনুছ (বর্তমান চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব), সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আ.জ.ম নাছির উদ্দিন সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৭ সালের ২৭ অক্টোবর ষোলশহরস্থ চশমাহিল নিজ বাসা থেকে তিনি গ্রেফতার হলে তাঁর ঘনিষ্ট সহকর্মী হাসান মাহমুদ শমসের (বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক) ও তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মরহুম সেকান্দর হায়াত খান একটি প্রাইভেট কারে করে সমগ্র শহর চসে বেড়ান এবং প্রতিটি এলাকায় নেতা-কর্মীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের নির্দেশনা দেন। গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পর মহিউদ্দীন ভাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন।
’৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ঙ্কারি ঘুর্নিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলো লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যায়। বহু মানুষ হতাহত হন। সেই সময় হালিশহর ফইল্যাতলী বাজারে মহিউদ্দিন ভাই আশ্রায়ণ কেন্দ্র ও চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র খুলেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে আশ্রিত দুঃস্তদের মাঝে ঔষধ, খাবার, বস্ত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিতরণ করেন। বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীনের সাথে আমিও সেখানে ছিলাম।
তিনি ছিলেন শিক্ষাবান্ধব মেয়র। সিটি কর্পোরেশনের স্কুলগুলো দ্বাদশ শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছিল তাঁর আমলে। ঐ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমূল পরিবর্তন আসে এবং লেখাপড়ার মান উন্নত হয়। সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যসেবাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মেধা শ্রম সবকিছু দিয়ে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের লক্ষে অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং করেছেন।
যখনই সাধারণ মানুষ অধিকারহারা হয়েছে সেখানে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। মহিউদ্দীন ভাই যখন উপলব্ধি করতে পারতেন যেকোন একটি কাজ জনগণের স্বার্থবিরোধী সেখানে তিনি প্রতিবাদ করতেন। এমনকি নিজ দলের সরকারের বেলায়ও তিনি তা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী গণমানুষের নেতা থেকে চট্টলবীর হয়েছিলেন। তৃণমূল থেকে উঠে এসে আঞ্চলিক নেতা হয়েও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার পর শ্রমিকরাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেমে পড়েন তিনি।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি বর্ণাঢ়্য রাজনৈতিক জীবনে ১৭ বছর তিনি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন নিষ্টার সাথে। দুইযুগ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মহিউদ্দীন চৌধুরীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর কোন বিকল্প নাই। চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র তিনি ‘চট্টলবীর’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি আর কোন দিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। তবে তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মকান্ড রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য আদর্শের পাঠশালা হয়ে থাকবে। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।