এবার কুষ্টিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর

0

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে দুই সপ্তাহের মধ্যে জেলায় দ্বিতীয় ভাস্কর্যে হামলা হলো। এবার ভাঙা হয়েছে কুমারখালীতে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী বাঘা যতীন নামে পরিচিত যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্য। এবারও রাতের আঁধারে এসেছে দুর্বৃত্ত। ভাস্কর্যের নাক ও মুখের একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১ে৭ ডিসেম্বর) রাতের কোনো এক সময়ে হাতুড়ি দিয়ে ভাস্কর্যের গাল ও নাকের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ভাস্কর্যটি উপজেলার কয়া মহাবিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত।

কুষ্টিয়া যাদের নামে গর্ব করে, তাদের একজন এই বাঘা যতীন। স্বভাবতই এই ভাস্কর্যটি ভাঙচুরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা করছে এলাকাবাসী। পুলিশ জানায় বৃহস্পতিবার রাতের কোনো এক সময়ে হাতুড়ি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে ভাস্কর্যটি। শুক্রবার সকালে স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে সেখানে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি। ভাস্কর্যটি কুমারখালী উপজেলার কয়া মহাবিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত। ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর এটি নির্মিত হয়। বিপ্লবী যতীনের বাবার বাড়ি ঝিনাইদহে হলেও তার জন্ম কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নে তার মামার বাড়িতে।

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, ‘কারা ভাঙচুর করেছে তা এখনও জানা যায়নি। জড়িতদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে।’

ভাস্কর্যটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় ছিল না বলে জানিয়েছেন থানার ওসি। সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকার কারণ হিসেবে অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, বাজেট স্বল্পতা।

অধ্যক্ষ হারুনার রশীদ বলেন, ভাস্কর্যের নিরাপত্তায় মিটিং করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। আসলে মিটিং করেও কোনো লাভ হতো না, সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে যে অর্থের প্রয়োজন তার সংস্থান নেই।

নিরাপত্তাকর্মী খলিলুর রহমান বলেন, ‘রাত ১২টার পর আমি তিনটি আঘাতের শব্দ শুনে দৌড়ে যাই। দেখতে পাই দুটি মোটরসাইকেল রাস্তার দুই দিকে চলে যাচ্ছে। এরপর ভাস্কর্যে আঘাতের চিহ্ন পাই। রাতেই বিষয়টি অধ্যক্ষ স্যারকে জানাই।’

ভাস্কর্য ভাঙচুরের বিষয়ে কথা বলার জন্য পুলিশ কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নিজামুল হক, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ ও নৈশপ্রহরী খলিলুর রহমানকে থানায় নিয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন। এই ভাস্কর্য কেন সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়নি এ প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি জানান, এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সিরাজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রিপোর্ট দিলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তা মোড়ে রাতের আঁধারে ভাঙচুর করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। সেই ঘটনাটি ধরা পড়েছে সিসিটিভি ক্যামেরায়। আর ফুটেজ পর্যালোচনা করে স্থানীয় ইবনি মাসউদ কওমি মাদ্রাসার দুই ছাত্র ও দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

আদালতে চার জনই এর দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা ফয়জুল করীমের বয়ান শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ভাস্কর্যটি ভাঙচুর করেছে।

রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে প্রথমে মাঠে নামে ইসলামী আন্দোলন। পরে মামুনুল হক হুমকি দেন, ভাস্কর্যটি নির্মাণ হলে তিনি ২০১৩ সালের ৫ মের মতো পরিস্থিতি তৈরি করবেন।

পরে তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভের পর কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই নেতারা নরম হয়েছেন। এখন তারা বলছেন, ভাস্কর্য নিয়ে সরকারের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ যাবেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কওমি প্রতিনিধি দলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভাস্কর্যবিরোধীরা আর মাঠে নামবে না। আর সরকারের মুখপাত্র তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ভাস্কর্য নির্মাণ অব্যাহত থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর ওই ভাস্কর্য ভাঙচুরের পর কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক জানিয়েছিলেন, জেলার সব ভাস্কর্যে তারা নিরাপত্তা জোরদার করেছেন।

ভাস্কর্য ইস্যুতে রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান নেয়ার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে।

আর সারা দেশে ভাস্কর্য ও ম্যুরালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

কে এই বাঘা যতীন :

বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর মামার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নে। পৈতৃক নিবাস ঝিনাইদহে। তার আসল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯১৫ সালে ৩৬ বছর বয়সে ভারতের বালেশ্বর বুড়িবালামের তীরে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক গোলাগুলির পর পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঘা যতীনের সেই ভিটায় জাদুঘর ও ক্যান্টনমেন্ট করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। বাকি সব সম্পত্তিসহ বাঘা যতীনের ভিটেবাড়ি হয়েছে বেদখল।

Share.

Leave A Reply