নব্বইয়ের দশকে ঈদ কার্ড ছিল আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম। ঈদ কার্ড ছাড়া ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করাটা যেন চিন্তাই করা যেতো না। সেই সময় রমজান এলে জমে উঠতো ঈদ কার্ডের বাজার। বর্তমানে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই ঈদ কার্ড। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঈদ কার্ডের আবদার বা আবেদন বলে কিছুই নেই। প্রযুক্তির রাজত্বে হারাতে বসেছে ঈদ কার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই সংস্কৃতি।
প্রিয়জনদের কাছ থেকে ঈদ কার্ড পাওয়ার প্রতীক্ষায় থাকতেন অনেকেই। প্রথম রমজান থেকেই শুরু হতো ঈদ কার্ড বেচাকেনা। একসময় ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বন্ধু-বান্ধবীরা একে অপরকে ঈদ কার্ড ধরিয়ে দিত। আবার অনেকে কাগজের উপর শিল্পের ছোয়া লাগিয়ে নিজে নিজে বানাতো ঈদ কার্ড। এমনকি ঈদকে ঘিরে পাড়া-মহল্লার অলিতে গলিতে বসতো বাহারি ঈদ কার্ডের দোকান। কার্ডগুলোতে শোভা পেত মসজিদ, কাবা শরীফ, মদিনা শরীফ, ফুল, তারকা ও পাখিসহ নানা ছবি।
বর্তমান ঈদ কার্ডের দোকানও তেমন দেখা যায় না। যেগুলো আছে ওই গুলোতে ক্রেতাদের দেখা নেই বললেই চলে। আন্দরকিল্লার ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও জমজমাট ছিল কার্ডের ব্যবসা। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হারিয়ে যেতে বসেছে এসব সংস্কৃতি। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, টুইটার, ই-মেইল, ফেসবুক, ই-কার্ড, এসএমএস, এমএমএসসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের কাজ সেরে নিচ্ছেন সবাই। ফলে ঈদ এলেও ঈদ কার্ড নিয়ে ব্যস্ততা নেই দোকানিদের।
ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে শুধুমাত্র বিয়ের কার্ড, ক্যালেন্ডার, ডায়েরির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। গত ঈদেও ঈদ কার্ড ছাপাননি অনেক দোকানি। আর করোনা পরিস্থিতির জন্য বর্তমানে করপোরেট হাউস, ব্যাংক-বীমা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ঈদ কার্ড অর্ডার করে থাকলেও সেগুলো সংখ্যায় একেবারেই সীমিত।
এ বিষয়ে নগরের আন্দরকিল্লায় রহমানিয়া প্রেসের আলমগীর হোসেন সিভয়েসকে বলেন, ‘আগে ঈদ মৌসুমে শুভেচ্ছা কার্ডের ব্যাপক প্রচলন ও জনপ্রিয়তা ছিল। আমরা খুব ভালো ব্যবসা করতাম। যারা অলি-গলিতে ভ্রাম্যমাণ দোকান দিত তারাও আমাদের কাছ থেকে ঈদ কার্ড কিনে নিয়ে যেত। অনেকে তো নিজস্ব ডিজাইন এনে বলতো এমন ডিজাইনের করে দিতে হবে। অথচ এখন মানুষ ঈদ কার্ডের খোঁজও করে না। সবাই মোবাইল আর ফেসবুকেই ঈদের শুভেচ্ছা জানায়।
আন্দরকিল্লার আলিফ প্রিন্টার্সের কর্মচারি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে ঈদ কার্ডের চাহিদা শূন্যের কোটায় পৌঁছে গেছে বলা চলে। আগে ঈদ কার্ডের জন্য মানুষ দোকানের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতাম আমরা। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষের ঈদ কার্ডের প্রতি আগ্রহ নেই। এ ধারাবাহিকতা থাকলে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই বিলুপ্তি ঘটতে পারে ঈদ কার্ড সংস্কৃতির।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হোমাইরা জাহান শৈল্পিক বিভিন্ন কিছু নিয়ে কয়েক বছর থেকে কাজ করে আসছেন। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘ঈদ কার্ডের প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে। আমরা যারা ক্রাফটসের কাজ করি, তারা এটাকে টিকিয়ে রাখতে নিজেরা বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করে থাকি।’
বন্দরের সুরমা আর্ট এন্ড গিফট সেন্টার ও স্টেশনারি মালিক অপু বড়ুয়া বলেন, ‘অল্প ঈদ কার্ড এনেছিলাম। ক্রেতা না থাকায় সাইজভেদে ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা দামে বিক্রি করে দিচ্ছি। সাইজ অনুযায়ী যেমন ৬ ও ৯ সাইজের কার্ডের মূল্য ১৫ টাকা এবং ৫ ও ৭ সাইজ কার্ডের মূল্য ৫ টাকা ধরে বিক্রি করছি। বর্তমানে মোবাইলে ১০ পয়সা খরচ করে এসএমএসের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো যাচ্ছে। এতে সময়ের পাশাপাশি মানুষের টাকাও বেঁচে যাচ্ছে। ১৫ টাকা দিয়ে কার্ড না কিনে একটা এসএমএসের মাধ্যমে ১০ পয়সা ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক। কষ্ট করে দোকানে এসে কার্ড ক্রয় করে আবার বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দেয়া তাদের কাছে কষ্টও বটে।’
আন্দরকিল্লা জিএ ভবনের আনোয়ার প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার আবদুস সালাম সিভয়েসকে বলেন, ‘এক সময় রোজা শুরু হওয়ার সাথে সাথে ঈদ কার্ড বিক্রির ধুম পড়ে যেত। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা বেশি ভিড় করতেন। বিগত কয়েকবছর ধরেই এ প্রচলন একেবারেই উঠে গেছে। তাই বিয়ের কার্ডের দিকেই নজর দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এই এলাকায় প্রায় এক হাজারের বেশি কার্ড প্রিন্টিংয়ের দোকান আছে।’ (সিভয়েস এর সৌজন্যে)