একটানা ভারী বর্ষণে নগরীতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা

0

 স্টাফ রিপোর্টার :

এখনো নগরীর অনেক পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে শত শত গরীব অসহায় মানুষ বসবাস করছে। এসব পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ বৃষ্টি এলে রাতে ঘুমাতে পারেন না। আতঙ্কে ভোগেন। বড় ধসের আশঙ্কার মধ্যেও পাহাড়েই বসবাস বহু পরিবারের। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন স্থানে ধসের আলামত দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ঘটতে পারে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা। তবু ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলের শত শত মানুষ বসবাস করছেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬ জেলার ১১টি থানা এলাকায় এখন পাহাড় ধসের ঝুঁকির মুখে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর পার করছে তারা অনেকটা নিয়তি-নির্ভরতার মধ্যে। প্রতি বর্ষা মৌসুম এলেই প্রমাদ গোণে তারা, টানা বর্ষণের দিনগুলোতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় পাহাড় ধসে জানমালের সর্বনাশের আশংকায়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪। এসব পাহাড়ে বসবাসকারীর মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজারের অধিক।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ু অক্ষের বর্ধিতাংশ পূর্ব-উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল ও মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় ও উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় আছে। ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত এবং পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূ সম্পক্তি কর্মকর্তা মো. মাহাবুব উল করিম চট্টগ্রাম নিউজকে জানান, নগরীর সবচেয়ে বড় পাহাড় হলো লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাড়। এটা মোট ২৬ একর। এখানে রেলওয়ের ১৮ একর। অবশিষ্ট ৮ একর চট্টগ্রাম ওয়াসা ও সড়ক ও জনপথের। এখানকার অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদর জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নানান কারনে তা হয়নি। এখন করোনার লকডাউনের কারনে মানবিক দিক বিবেচনায় আমাদের উচ্ছেদ অভিযান এখন বন্ধ আছে। লকডাউনের পর আবার শুরু হবে।মতিঝর্ণা পাহাড় থেকে উচ্ছেদে আইনগত কোন বাধা নেই। এটা উচ্ছেদের জন্য শুধু পুলিশ দিয়ে হবেনা। এখানে বিজিবি ও ব্যার লাগবে।

এই ব্যাপারে চসিকের লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল চট্টগ্রাম নিউজকে জানান, তারা দীর্ঘদিন যাবত লালখান বাজারের মতিঝর্ণার পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। তাদের কোথাও স্থায়ী ভাবে পুনর্বাসন করা দরকার।

পাহাড় ধসের কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। স্মরণকালে ভয়াবহ ট্রজেডি ঘটে ২০১৭ সালে। ওই বছর ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। এছাড়াও ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে এভাবে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত ১৪ বছরে পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে তিনশ’ মানুষ। এরমধ্যেে একটি বড় ট্রাজেডি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই দিনে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন।

এভাবেই প্রতি বর্ষায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আসে পাহাড়ি জনপদে,পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। বছরের পর বছর এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও দীর্ঘস্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বরং বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টি শুরু হলে এসব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু হয়।

পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্নআয়ের। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টাকার বিনিময়ে নিম্নআয়ের মানুষের ঘর তৈরি করতে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।

Share.

Leave A Reply