বিশেষ প্রতিনিধি
সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়: শুধু মহাকাব্য হিসেবেই নয়; হিন্দুধর্মে পুরাণ হিসেবে রয়েছে রামায়ণের ব্যাপক গুরুত্ব। রামায়নের প্রেক্ষাপটে রাম-সীতা-লক্ষণের কাহিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষের যেসব স্থান জড়িত তার অন্যতম সীতাকুণ্ড। সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড়কে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বছর ধরে এসব উপাখ্যান ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সীতার কুণ্ড, রাম-লক্ষণের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। হিন্দু গ্রন্থ অনুসারে সতী দেবীর দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল এখানে।
আপনি এখানে বেড়াতে এলে শুধু বেড়ানোই হবে না, পাশাপাশি অনেক পুরাণ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে নিজের অজান্তে।
সাড়ে তিন কিলোমিটার উঁচু চন্দ্রনাথ পাহাড়ের একেবারে উপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। সেখান থেকে শুরু করে একেবারে নীচ পর্যন্ত পুরো পাহাড় জুড়ে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য মন্দির। ঠিক কতোগুলো মন্দির এখানে রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে আপনি বেড়ানোর সময় আপনার চোখে উল্লেখযোগ্য যে মন্দিরগুলো চোখে পড়বে সেগুলো হলো শংকর মঠ, ব্যাসকুণ্ড পুকুর, শয়ম্ভুথাথ বাড়ি ইত্যাদি।
এছাড়া সীতাকুণ্ড সদর জুড়ে আছে ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দ গিরি সেবাশ্রম, কাছারী বাড়ি, শনি ঠাকুর বাড়ি, প্রেমতলা, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রাহ্মচারী সেবাশ্রম, শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, গিরিশ ধর্মশালা, দোল চত্বর, এন,জি,সাহা তীর্থযাত্রী নিবাস, তীর্থ গুরু মোহন্ত আস্তানা, বিবেকানন্দ স্মৃতি পঞ্চবটি, জগন্নাথ আশ্রম, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, মহাশ্মশান ভবানী মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, বিরুপাক্ষ মন্দির, পাতালপুরী, উল্টা কালী মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির ইত্যাদি।
এই পাহাড় ও তীর্থভূমিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ঘটা করে পালিত হয় শিব চতুর্দশী মেলা। যা প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার থেকে এই মেলায় প্রচুর দর্শনার্থী এসে থাকে। প্রতি বছর মেলায় প্রায় ১০ লাখের বেশি লোকের সমাগম হয়।
সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক: সীতাকুণ্ড পৌর সদর থেকে মাত্র মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পার্শ্বে সমতল ভূমি ও পাহাড় জুড়ে স্থাপিত হয়েছে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক। এখানেই প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম বোটানিক্যাল গার্ডেন সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রচুর গাছগাছালি ও সবুজের সমারোহে পাহাড়ের বুক চিরে উঠে গেছে সরু রাস্তা। এই রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দেখবেন চিত্রা হরিণ, খরগোসসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সৌন্দর্য্যের অন্যতম উৎস বিশাল ঝর্ণা। যা `সুপ্তধারা` নামে পরিচিত। এই পাহাড়ে বসেই কবি নজরুল লিখেছিলেন, “অাকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই”।
দারোগাহাট সহস্রধারা: সীতাকুণ্ড পৌরসদরের দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ও ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে গেলেই আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা আপনার সামনে অবস্থিত। সমুদ্রের মতো গর্জন নয়, তবে অদ্ভুত এক মোহনীয় ঝংকার তুলে হাজার হাজার সারিতে পাহাড় থেকে নেমে আসছে ঝর্ণার স্রোতধারা। প্রতিদিন প্রচুর নারী-পুরুষ, স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা বেড়াতে আসছে এখানে। তারুণ্যের এমন কোলাহল সাম্প্রতিক সময়ে আর কোথাও ঘটে বলে মনে হয় না। স্বপরিবারে এখানে বেড়াতে এসেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল আলাম। স্ত্রী ও চার বছরের সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন তিনি। এ প্রতিবেদককে বলেন, ঝর্ণার সামনে এলে মন বড় হয়। আমি আমার সন্তানকে এখানে এনেছি যেন তার মনে ঝর্ণার মন ভালো হয়।
বাঁশবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকত: সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে ও ডিটি রোড থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত বাঁশবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকত। বেড়ীবাঁধ সংলগ্ন এ সৈকতে সারাবছরই ভীড় থাকে নারীপুরুষের। এ সৈকতে হাঁটার সময়ে আপনাকে ছুঁয়ে যাবে সমুদ্রের জল। ইচ্ছে করলে প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়তে পারেন পানিতে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট-এ ছুটে বেড়ায় হরিণ। বালুচরে ঘুরে বেড়ায় সামুদ্রিক কাঁকড়া। দর্শনার্থীদের ভীড় আছে, কিন্তু সমুদ্রের গর্জনে তাদের কোলাহল ঢাকা পড়ে। তৈরি করে এক অপূর্ব নিস্তব্ধতা। সূর্য ডোবার সময় হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবেন সূর্য। এখানে বেড়াতে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারহানা সাঁথিয়া। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সাঁথিয়া জানায়, সে প্রায় এখানে ঘুরতে আসে বন্ধুদের সাথে। এখানে আসতে হলে কক্সবাজারের দূরত্ব নেই, পতেঙ্গার ভীড় নেই, আছে সমুদ্রের গর্জন আর সৌন্দর্য্যের সমারোহ।
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত পর্যটন ক্ষেত্র গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত সীতাকুণ্ডে অবস্থিত। সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে অবস্থিত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, প্রচুর ঘাস, আর সমুদ্রের পানি-এই নিয়েই গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। বিশাল সবুজ চর জুড়ে আছে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ।
সবুজ ঘাসে কান পাতলে শুনতে পারবেন মাটির ভেতরে সমুদ্রের গর্জন। উপরে পাখির ডাক, নীচে সমুদ্রের গর্জন-এমন অনুভূতি দেশের আর কোথাও নেই। দেশের ভেতরে প্রকৃতিকে এমনভাবে উপভোগ করার এমন সুযোগ কেন হাতছাড়া করবেন?
ভাটিয়ারী বিএমএ লেক: শহরতলীর এলাকা ভাটিয়ারী। ভাটিয়ারী বাজার থেকে এককিলোমিটার ভেতরে গেলেই শুরু হয় উঁচু নীচু পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে চিকন সাপের মতো বয়ে গেছে রাস্তা। খাড়া পাহাড় বেয়ে রাস্তা কখনো উঠে যায় অনেককখানি। আবার নামে। কখনো বাঁক ফিরে। কখনো মোচড় দেয় ঘুমন্ত অজগরের মতো। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লেক। ভাটিয়ারী বিএমএ লেক। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী (বিএমএ) পাশে অবস্থিত বিধায় একে বলা হয় বিএমএ লেক। লেকের স্বচ্ছ পানিতে চুল আঁচড়ানো সম্ভব। লেক সংলগ্ন পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে দেখবেন, উঁচু নীচু পাহাড়গুলোর শুরু অাছে শেষ নেই। বুঝতেই পারবেন না অাপনি কী বাংলাদেশে অাছেন নাকি দার্জিলিংয়ে।
আপনার গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে উঠবে তখন সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি ভয়ে আপনার দম বন্ধ হয়ে আসা বিচিত্র কিছু নয়। আবার গাড়ি যখন নামবে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যাবে শীতল স্রোত। তবে আপনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্য্য দেশে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন আপনি।
প্রকৃতি তার উদারহস্তে সাজিয়েছে আমার বাংলার মাটিকে। এখানে পাহাড় সমুদ্রের সঙ্গম যেমন ঘটেছে তেমনি আছে প্রচুর বনজ পশুপাখির মিলন। এসব রেখে কেন যাবেন নেপাল, ভুটান বা ভারতের দার্জিলিং। সীতাকুণ্ড ঘুরে আসুন, তাহলে সত্যতা পাবেন এমন দাবির।