মুজিববর্ষে দেশের সকল গৃহহীনকে ঘর করে দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত প্রধানমন্ত্রীর

0
ঢাকা, ২০ জুন, ২০২১ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীন-গৃহহীনদের মাঝে ৫৩ হাজার ৩৪০টি ঘর বিনামূল্যে বিতরণকালে মুজিববর্ষে দেশের সকল গৃহহীনকে ঘর করে দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দেশের সকল ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ ঘর পাবে। একটি মানুষও আর ঠিকানা বিহীন থাকবে না।’
জাতির পিতা এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ একটা ঘর যখন পায়, তার মধ্যে যে আনন্দ, তাঁর মুখে যে হাসি, এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছু নয়। আমি মনে করি, আমার জন্য এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।’ ‘ক্ষমতা মানে ভোগ বিলাস নয়। ক্ষমতা হলো মানুষের সেবা করা। মানুষের জন্য কাজ করা,’ যোগ করেন তিনি।
গত জানুয়ারিতে প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে ঘর প্রদানের পর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে এদিন আরো ৫৩ হাজার ৩৪০ পরিবারকে দুই শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর উপহার দিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের ৪৫৯টি উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীন এসব মানুষকে ঘর দেওয়ার এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জমির দলিল ও ঘরের চাবি উপকারভোগীদের হাতে তুলে তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার কারণে আমি যেহেতু যেতে পারিনি। আমার পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ডিসি এবং ইউএনও জমির দলিল ও ঘরের চাবি তুলে দেবেন।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্যই মানুষ। মানুষের জন্য তাঁদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারাটাই সব থেকে বড় কথা।’
‘আমাদের দেশটা দুর্যোগ প্রবণ একটি দেশ’-সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই এই ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনকে ঘরে-বাড়ি করে দেওয়া এবং জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধ্যমে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়েই তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঘর-বাড়ি নির্মাণে আমরা প্রশাসনের ওপর সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী-যাদেরকেই দায়িত্ব দিয়েছি তারা অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজগুলো করেছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
দলিলে জমির মালিকানা স্বামী ও স্ত্রীর যৌথ নামে করে দেয়া হয়েছে। তাদের নামে স্থায়ী দলিলের পাশাপাশি নামজারি করে খাজনা দাখিলাও দেয়া হয়েছে। সেমিপাকা ঘরে আছে দুটি রুম, একটি বড় বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট। পাশাপাশি সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও আছে। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যালয়, খেলার মাঠ এবং মসজিদসহ ধর্মীয় উপাসনালয় ও রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশকে দারিদ্র মুক্ত করায় তাঁর সরকারের লক্ষ্য পূরণে সবথেকে বেশি যে জিনিসটির দরকার সেটি হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছে দেওয়া।
জাতির পিতা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ১০ শয্যার হাসপাতাল তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করে শুরু করেছিলেন, উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তাঁর সরকার পরবর্তীতে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে ৩০ প্রকারের ওষুধও বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে সেখান থেকে। পাশাপাশি, মাতৃত্বকালীন সেবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান ল্যাকটেটিং মাদারকে ভাতার আওতায় নিয়ে আসা এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারও তাঁর সরকার কমাতে পেরেছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। তিনি অনুষ্ঠানে ‘অন্তভূক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’ শীর্ষক একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী ৪টি উপজেলার উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন।
একসঙ্গে এত মানুষকে বিনামূল্যে বাড়ি-ঘর দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে নজিরবিহীন উল্লেখ করে করে ড. আহমদ কায়কাউস তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আরও ১ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ ঘর প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪৩৬টি ঘর রংপুর বিভাগে প্রদান করা হয়। এছাড়া, চট্টগ্রামে ১০ হাজার ৫৪৭টি ঘর, রাজধানী ঢাকায় ৭ হাজার ৬৩০টি ঘর, রাজশাহীতে ৭ হাজার ১৭২টি, ৩৭ হাজার ১৫৩টি বরিশালে, ৯১১টি খুলনায়, ২ হাজার ৫১২টি ময়মনসিংহে এবং ১ হাজার ৯৭৯টি ঘর সিলেট বিভাগে প্রদান করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ছিন্নমূল মানুষকে একটা ঠিকানা করে দেওয়ার মাধ্যমে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করে দেয়ার এই প্রকল্পকে কেবল আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমেই নয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ পুণর্বাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নানাবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের কর্মকান্ডে উৎসাহিত হয়েই সচিব এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বেসরকারি খাতেও অনেকে এগিয়ে এসে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
তিনি এজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘সবার ভেতরে এই চেতনা জেগেছে যে-ছিন্নমূল মানুষ যারা বস্তিতে, ফুটপাতে, রেললাইনের ধারে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে মানবেতরভাবে জীবনযপন করছে সে যখন একটা আশ্রয় পায় তখন তার জীবনটাই বদলে যায়।’
তিনি এ সময় কোভিড-১৯ সহসাই যাচ্ছে না,উল্লেখ করে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও পুণরায় স্মরণ করিয়ে দেন।
বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি । যাতে এই ভাইরাস একজনের কাছ থেকে অপরজনকে সংক্রমিত করতে না পারে। পাশাপাশি তিনি সরকারের টিকা দান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার এবং আরো জোরেসোরে শুরু করার কথাও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভূমিহীনদের জন্য খাসজমি বন্টনে জাতির পিতার শুরু করে যাওয়া ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্পের পদাংক অনুসরণ করেই ’৯৬ সালে সরকারে আসার পর তাঁর সরকার ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বিতরণ এবং গৃহহীন-ভূমিহীনকে ঘর করে দেয়ার ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের শুরু করে।
তিনি বলেন, সে সময়ই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে গৃহহীন তহবিল নামে একটি তহবিলও গঠন করেন। এ তহবিল থেকে এনজিওগুলোকে ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ দেয়া হতো যাতে যাদের ভিটে আছে তাদের একটি ঘর করে দিতো। এই শর্তে যে, তারা ৫ শতাংশের বেশি উপকারভোগীদের কাছ থেকে নিতে পারবেন না এবং সেভাবেও প্রায় ২৮ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।
তিনি বলেন, ঘুুর্ণিঝড় বিধবস্থ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এক নেতার সহযোগিতায় তাঁর প্রদত্ত জমি দিয়েই নৌবাহিনীর তত্বাবধানে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৭০টি পরিবারকে প্রথম পুনর্বাসন করে তাঁর সরকার। যদিও তখন দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিলনা।
কেননা ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে এদেশে কেবল লুটপাটের রাজনীতিই করে গেছে কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই করেনি, বলেন তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, ‘ঐ সীমিত সম্পদ দিয়েই আমরা ভূমিহীন-গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসিত করার কাজটা শুরু করি এবং এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখের কাছাকাছি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে আমরা ঘর প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারে এসেই তাঁদের প্রচেষ্টা ছিল অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে আরো স্বাবলম্বী করা। যে কারণে তাঁর সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর বাস্তবায়ন শুরু করে এবং ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্থদের কক্সবাজারেরই একটি জায়গা ‘খুরুশকুল’ এ বহুতল ভবন নির্মাণ করে পুনর্বাসন শুরু করে। পাশাপাশি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নদীর ভাঙ্গনে নি:স্ব হয়ে যাওয়া লোকজনকে খুঁজে বের করে তাঁদের ঘর-বাড়ি করে দেওয়া হচ্ছে।
সরকারপ্রধান বলেন, অর্থনৈতিক নীতিমালায় আমরা তৃণমূলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আমরা গ্রাম পর্যায়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া, তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও বাসস্থান নিশ্চিত করা এবং তৃণমূল মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোথাও কেউ গৃহহীন থাকলে আমাদের জানাবেন। আমরা তাদের বাড়ি করে দেব। আমি মনে করি- এতোটুকু করতে পারলে আবার বাবার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) আত্মা শান্তি পাবে।
তিনি বলেন, আমি পুরো বাংলাদেশ ঘুরেছি, গ্রাম-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে। কোথায় কী সমস্যা জানি। আওয়ামী লীগ অধিকার নিয়ে কাজ করে। জাতির পিতা মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
উপকারভোগীদের সঙ্গে কথপোকথনে মৌলভীবাজারের কালাপুর ইউনিয়নের মাইজদিহি গ্রামের বীরাঙ্গনা বয়োজেষ্ঠ্য নারী শিলা গুহ সহ বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর নিকট ভিডিও কনফারেন্সে নিজস্ব অভিব্যক্তি তুলে ধরেন।
বীরাঙ্গনা শিলা গুহ বলেন, ‘আমি ঘর পেয়ে খুবই খুশি। আগে রাস্তার ভিখারি ছিলাম, এখন আমি লাখপতি। শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য আমি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। ভগবান আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) দীর্ঘজীবী করুন।’
অশ্রসিক্ত নয়নে তিনি বলেন, ‘আমি যুদ্ধের সময়ও ভাবতে পারিনি যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ বয়সেও আমাকে দেখে রাখবে। তাই আমি ভীষণ ভীষণ খুশি হয়েছি তার প্রতি।’
নতুন বাসগৃহে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালে প্রধানমন্ত্রী সাদরে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রান্ত থেকে কুড়িগ্রামের সদর, শেরপুরের ঝিনাইগাতি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন ও সুবিধাভোগীরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এছাড়া দেশের আরও ৪৫৫টি উপজেলা ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিল।
Share.

Leave A Reply