জেলা ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলায় সর্বাধিক ১০টি ইটভাটা রয়েছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় কোনও ভাটা না থাকলে সীমান্তবর্তী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার একাধিক ইটভাটা থাকার প্রভাব পড়ছে সেখানকার পরিবেশ ও স্থানীয় জনজীবনে। এছাড়া জেলার সদর উপজেলায় ৯টি, দিঘীনালায় ৩টি, পানছড়িতে ৩টি, গুইমারার ৫টি, মানিকছড়িতে ২টি, মহালছড়িতে ৪টি ও রামগড়ে ৭টিসহ মোট ৪৩টি ইটভাটা রয়েছে।
সূত্র বলছে, প্রতি বছর জেলায় অক্টোবর মাসে ইটভাটাগুলোর কাজ শুরু হয় এবং তা চলে মে-জুন পর্যন্ত। বৃষ্টির আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ইটভাটায় ১২-১৩ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রত্যেক রাউন্ডে৭/৮ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রত্যেক ইটভাটায় বছরে গড়ে এক কোটি ইট উৎপাদন হয়। খাগড়াছড়ির সব ভাটায় বছরে প্রায় ৪৩ কোটি ইট তৈরি হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ২১৫ থেকে ২২০ কোটি টাকা (প্রতি হাজার গড়ে ৫/৬ হাজার টাকা ধরে)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি রাউন্ড ইট পোড়াতে প্রায় ৮-৯ হাজার মণ (১ মণে ৪০ সের) জ্বালানি কাঠ লাগে এবং এক মৌসুমে একটি ইটভাটায় গড়ে কাঠ পোড়ে প্রায় এক লাখ মণ। সেই হিসেবে ৪৩ ইটভাটায় বছরে কমপক্ষে ৪৩ লাখ মণ কাঠ পুড়ছে। ইটভাটা এবং ভাটা শ্রমিকের রান্নাবান্নার কাজেসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার গাছ পুড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইটভাটাগুলোতে এসব জ্বালানি কাঠ যাচ্ছে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বন থেকে। ইটভাটায় গাছের ছোট ছোট ডালপালা বা পাতা ব্যবহার হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটা মোটা গাছ করাত দিয়ে কেটে ছোট ছোট টুকরা করে ইটভাটার চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে।
“>পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ, এসব কাঠ সরবরাহে কয়েক কোটি গাছ কাটা হচ্ছে। আর এভাবে ইটভাটা চলমান থাকলে আগামী কয়েক বছরে খাগড়াছড়িতে বন বলতে কিছু থাকবে না বলে আশঙ্কা তাদের। বন না থাকলে বন্যপ্রাণী, পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গ হুমকিতে পড়বে, নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য।
গাছ সরবরাহকারী খাগড়াছড়ি সদরের কাবিল হোসেন, রহিম উল্ল্যাহ, পানছড়ির উৎপল চাকমা ও বাঁশি কার্বারি বলেন, জেলার ৪৩ ইট ভাটায় গড়ে ৫০ কোটি টাকার জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, কাঠ সরবরাহকারীরা প্রত্যেকে বছরে প্রতি মণ গাছ ৯০ থেকে ১০০ টাকা হারে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। একটি ইটভাটায় বছরে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি টাকার কাঠ সরবরাহ করতে হয়। এসব কাঠ স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে কেনেন বলে জানান তারা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, গাছ সরকারি বনের, না বনাঞ্চলের না ব্যক্তি মালিকানার সেটা দেখার বিষয় নয়। কোনও গাছ অবৈধভাবে সংগ্রহ করা হয় না। নগদ টাকা দিয়ে গাছ কেনা হয়। কে বৈধভাবে কাটলো, আর কে অবৈধভাবে কাটলো তা দেখাতো আমাদের বিষয় নয়।
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ল’ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) সদস্য আবু দাউদ মুহাম্মদ বলেন, ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ এর ৮ ধারায় কোথায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে, আর কোথায় যাবে না তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না খাগড়াছড়িতে। কিছু কিছু ইটভাটা ১২০ ফুট লম্বা কংক্রিটের তৈরি চিমনি দিয়ে চললেও বেশিরভাগ ইটভাটা চলছে ২৫ থেকে ৩০ ফুট লম্বা ড্রাম চিমনি নিয়ে। ইটভাটাগুলোর অব্যাহত ধুলি ও ধোঁয়ার কারণে ইটভাটার শ্রমিকের পাশাপাশি স্থানীয় শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও অ্যাজমাসহ নানারোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া কৃষি উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়গুলো শক্তভাবে মোকাবিলা না করলে পরিবেশ ধ্বংস হবে, আমরা বিপর্যের মুখে পড়বো।
সাংবাদিক ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন আইনের ৫(১) ধারায় জমির উর্বর মাটি ও পাহাড়ের মাটি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও খাগড়াছড়ির কোনও ইটভাটায় তা মানা হয় না। খাগড়াছড়ির প্রতিটি ইটভাটায় ফসলি জমির উপরিভাগ এবং পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশ অথবা পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটাগুলো। খাগড়াছড়িতে কোন ইটভাটা পরিবেশ অধিদফতর হতে ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসকের নিকট থেকে লাইসেসন্স পায়নি বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশীল নেতারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে এসব ইটভাটা চালাচ্ছে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও খাগড়াছড়িতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তিনি দ্রুত অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তবে প্রকাশ্যে কাঠ পোড়ালেও তা অস্বীকার করছে ভাটা মালিকেরা। দিঘীনালা উপজেলার হাজী ব্রিকসের মালিক মো.নাসির উদ্দিনের দাবি, চলতি বছর কাঠের পরিবর্তে তারা কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন, গাছ রাখা হয়েছে শুধু চুলায় আগুন দেওয়ার জন্য।
খাগড়াছড়ি জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এটিএম রাশেদ উদ্দিন, ইটভাটা মালিক মো. সেলিম, আশরাফুল ইসলাম, আবুল কাশেম, মোস্তফা মিয়া বলেন, স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা উন্নয়ন কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তারা ইটভাটা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তারা পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাক্রমে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বেশিরভাগ ইটভাটায় চলতি বছর কয়লা ব্যবহার করা হবে উল্লেখ করলেও তারা বলেন, জ্বালানি কাঠ সহজে পাওয়া যায়, তাই তারা কাঠও ব্যবহার করেন।
“>এছাড়া ফসলি জমির মাটি ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটায় ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেন তারা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, যদি ধোয়া ও ধুলি থেকে লোকজন ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে প্রতিদিন কয়েকশ’ গাড়ি বাইরের জেলা হতে খাগড়াছড়ি আসছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এসব গাড়ি তেল পোড়াচ্ছে, ধুলা ও ধোঁয়া উড়াচ্ছে-তাতে কি কারও সমস্যা হয় না, সব কি শুধু ভাটা মালিকদের দোষ?
এদিকে বনের কাঠ ইটভাটায় পোড়ানো বন্ধে টাস্কফোর্স করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সরোয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় বন বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোনও গাছ কাটা ও পরিবহন সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ইটভাটার অনিয়ম বন্ধ করা হবে।’
জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান ইটভাটা মালিকদের ইতোমধ্যে সাবধান করা হয়েছে তারা যেন বনের কাঠ, ফসলি জমির উর্বর মাটি, পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটায় ব্যবহার করা যাবে না। ইটভাটা মালিকেরা যদি প্রশাসনের নির্দেশনা না মানেন, তাহলে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে ইটভাটা মালিকদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত বছর বেআইনিভাবে ইটভাটা চালানোয় বিভিন্ন ভাটায় ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ করলে এবার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গত সপ্তাহে পানছড়িতে পাহাড় কেটে ইট ভাটায় ব্যবহারের চেষ্টা করায় এসকাভেটর ও ট্রাক্টর রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।