গুমাই বিলে ওড়াউড়ি

0

কুয়াশার পর্দা সরে সূর্যের নরম আলোয় চিকচিক করছে ধানের শীষে শিশির বিন্দু। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খেতে থাকা বিস্তীর্ন ফসলের মাঠ জুড়ে এক উৎসবের আমেজ। কাস্তে হাতে নিয়ে ব্যাস্ত কৃষক দলবেঁধে অংশ নিয়েছে এই উৎসবে। এই উৎসব ধান কাটার উৎসব। বলছি চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের কথা।

প্রায় তিন হাজার হেক্টর আয়তনের গুমাই বিলে  এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন পুরো গুমাই বিল জুড়ে চলছে ধান কাটার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে প্রশান্তির হাসি। কৃষকের হাসি আর দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ এই দুইয়ে মিলে চারপাশে এক আনন্দময় পরিবেশ। এ যেন সত্যিকারের এক প্রশান্তি।

দিনের প্রথম ভাগের কাজ শেষে পরিশ্রান্ত কৃষক খেতে বসেছে তার দুপুরের খাবার। ফলন ভালো হওয়াতে যারপরনাই খুশি কৃষক আব্দুর রহিম। তবে কথার শেষে একটা চাপা বিরক্তির সুর কৃষকের কন্ঠে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই খেতে খেতে বললেন ‘একটূ পরেই বুঝবেন’। দুপুর গড়িয়ে যায়, মধ্যগগণে থাকা সুর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করে। বিকেল নামতে শুরু করে গুমাই বিলে। সময়ের সাথে সাথে দিনের আলোর মত তখন পাল্টাতে শুরু করে বিলের চারপাশের চিত্র।এ যেন অন্যরকম এক পরিবেশ। চিরচেনা গুমাই বিলের সৌন্দর্য মুহুর্তেই পাল্টে ধরা দেয় অন্যরুপে। একটি দুটি নয় ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি এসে ভীড় করে পুরো বিল জুড়ে। দূর থেকে দেখে মনে হয় এ যেন টিয়া পাখিদের এক বিশাল মিলন মেলা। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াদের কয়েকটি দল ছড়িয়ে পড়ে  বিলের বিভিন্ন প্রান্তে। কোন দল মাঠে ধান খাচ্ছে তো আবার কোন দল উড়ে বেড়াচ্ছে বিলের বিশাল আকাশ জুড়ে। এত টিয়া পাখি একসাথে বোধহয় বাংলাদেশে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।

এ এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ইতোমধ্যে কৃষকরা ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের এই ব্যাস্ততা পাখি তাড়ানোর জন্য। খালি টিনের বাক্স পিটিয়ে বা মুখ দিয়ে নানান রকম শব্দ ব্যাবহার করে কেওবা হাত তালি দিয়ে পাখি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘বুঝলেনতো কেন বিরক্ত’ বললেন কৃষক। ‘ওরা আশপাশের পাহাড় জঙ্গল থেকে শুধু এই সময় আসে ধান খেতে, এরমধ্যে ৫ বা ৬ মণের মত ধান খেয়ে ফেলেছে’ আক্ষেপের সুরে বললেন আরেক কৃষক কফিল উদ্দীন।

পাখি শিকার বা নিধনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই কৃষকরা একযোগে বলেন, পাখি তাড়াতে তারা বাজি বা বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যাবহার করেন ঠিকই, তবে পাখি শিকার বা নিধন করেন না। কৃষকদের সাথে কথা বলতে বলতে সূর্য আরো পশ্চিমে হেলে পড়ে। গোধুলীর আলোয় রাঙ্গা হয় গুমাই বিলের অবারিত প্রান্তর। টিয়াদের দল দখল করে নিয়েছে পুরো আকাশ। এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে তারা।

রঙ্গিন পাখিদের বিচরণে এক মাদকতাময় রং ছড়িয়ে পড়েছে গোটা গুমাই বিল জুড়ে। এটাই বুঝি প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির এক অপূর্ব সমন্বয়। সন্ধ্যা হতেই শত শত টিয়া  ডানা ঝাপটাতে শুরু করে , অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা ফিরতে শুরু করে তাদের আপন ঠিকানায়, তাদের ছোট্ট নীড়ে।

রাত্রি শেষে দিনের আলোয় আবার ফিরে আসবে এই টিয়া পাখির ঝাঁক। ধান খেয়ে কিচির মিচির ডাকে উড়ে বেড়াবে মুক্ত আকাশে। এমন দৃশ্য গুমাই বিলে মঞ্চস্থ হোক বারবার, গুমাই বিলে তাদের এই ওড়াউড়ি হোক নিরাপদ, প্রকৃতি বেঁচে থাক তার আপন নিয়মে।

Share.

Leave A Reply