পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৩ বছর: চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মত

0

বিশেষ প্রতিনিধি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আজও বিতর্ক শেষ হয়নি। এত বছর পরও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মত। সরকারপক্ষ বলছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলোও বাস্তবায়িত হবে। অপরদিকে জেএসএসের অভিযোগ, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে লঙ্ঘন করছে। 

পাহাড়ের তিন সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়। আর শান্তিচুক্তি সংশোধনের দাবিতে বাঙালি সংগঠনগুলো আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।

চুক্তির পর থেকেই পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সংঘাত লেগেই আছে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনও করেন।

বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলার দীর্ঘদিনের পাহাড়ি-বাঙালিদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্যাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের স্বশস্ত্র বাহিনীর (শান্তি বাহিনী) সাথে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

কিন্তু শান্তিচুক্তির ২৩ বছর পরেও পাহাড়ে পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পাল্টাপাল্টি আর সংঘাতে আজও উত্তাল পাহাড়ি জনপথ। এ নিয়ে একে অপরকে দুষছেন পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা। তবে দ্রুত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে মনে করেন পাহাড়ি নেতারা।

এদিকে জেএসএস নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও এখনও পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরে আসেনি। বরং চুক্তির পর পাহাড়িদের জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ তিনটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে।

পার্বত্য চুক্তির প্রশ্নে তাদের অবস্থানের ভিন্নতা রয়েছে। এ ভিন্নতার কারণে পাহাড়িদের মধ্যে ঘটছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। পাহাড়ে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতাদের রয়েছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য।

সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রায় ৯০ ভাগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নে উভয়পক্ষে এক সাথে বসে সমাধান করার কথাও বলা হচ্ছে। শান্তিবাহিনীর সকল সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হয়েছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না এমন অভিযোগ ভিত্তিহিন।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, যে শান্তিচুক্তি হয়েছে সরকার ও জেএসএস এর মধ্যে; তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হবে বা জনগণ মুক্তি পাবে, জনগণ উপকৃত হবে তা আমরা মনে করি না।

যার কারণে আমরা শান্তিচুক্তি বিরোধিতা করে আসছি। বর্তমানে পার্বত্য এলাকার যে পরিস্থিতি হানাহানি খুনাখুনি হচ্ছে এবং ভূমির উপর নানা আগ্রাসন হচ্ছে, এগুলো শান্তিচুক্তির কোনো সুফল নয়।

মানবাধিকারনেত্রী ডনাই প্রু নেলী বলেন, শান্তিচুক্তি হয়েছে শুধু পাহাড়িদের জন্য, পাহাড়ের বসবাসরত সব মানুষের জন্য। পাহাড়ে শান্তিচুক্তির পর অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে আমরা যেভাবে আশা করেছিলাম, উন্নয়নের পাশাপাশি পাহাড়ের মানুষরা শান্তিতে বসবাস করবো, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবো, সেই জায়গাটায় এখনও আতঙ্ক রয়ে গেছে। শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে, এখানকার প্রতিটি সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, ২৩ বছরেও শান্তিচুক্তির কোনো সুফল পাহাড়ের মানুষ পায়নি।

শান্তিচুক্তির অধিকাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেখানে সেনা ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার কারণে পাহাড়ে এখও হানাহানি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। তবে পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অস্থায়ী সেনাক্যাম্প পুনরায় স্থাপন করা হলে হানাহানি বন্ধ হবে।

তিনি আরও বলেন, শান্তিচুক্তির পর জেএসএস তাদের স্বার্থ উদ্ধারের পর পাহাড়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুম খুন করা হচ্ছে।

জেএসএস এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক কে এস মং বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সন্তু লারমার মধ্যে একটি বৈঠক করতে হবে। ঐ বৈঠকের মাধ্যমে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হবে নাকি হবে না, তা পার্বত্যবাসী ও সারাদেশের মানুষকে জানাতে হবে।

এই ম্যাসেজটি যদি দেওয়া না হয়, তবে পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস আছে, শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে তিনি এগিয়ে আসবেন।

জেএসএস এর এই নেতা আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বিভাগ, ভূমি সংক্রান্ত বিষয় এবং সাধারণ প্রশাসন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু ১৯৮৯ সালের স্থানীয় সরকার গঠনের পর এরশাদ সাহেবের আমলে যে বিধিমালা গঠন করা হয়েছে, সেই বিধিমালা দিয়েই পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো চলছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক বিষয়গুলো হস্তান্তর না হওয়ার কারণেই পার্বত্য অঞ্চল আরও জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।

চুক্তি বাস্তবায়নে আগে যে আন্তরিকতা ছিল সেটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ফলে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির যে বৈঠক হয়েছে আজ প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে আর কোন বৈঠক হচ্ছে না। চুক্তি যাতে বাস্তবায়ন না হয় সেজন্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহল কাজ করছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, শান্তিচুক্তির ফলে শিক্ষাসহ জীবনমান যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে অতীতে কোনোকালেই পাহাড়ের সাধারণ মানুষ তা ভোগ করতে পারেনি।

শান্তিচুক্তির ৯০ ভাগ শর্ত ইতোমধ্যে সরকার বাস্তবায়ন করেছে। তবে বাকি কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নে উভয়পক্ষকে এক সাথে বসে সমাধান করার জন্য বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু এটাকে জিইয়ে রেখে স্বার্থহাসিলের জন্য জেএসএস নিজের দোষ এখন সরকারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় এখন অস্ত্রের ঝনঝনানি, সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ। চাঁদাবাজি, গুম, খুন নিয়েই চলছে পার্বত্য অঞ্চল।

আওয়ামী লীগের এই নেতার মতে, ১৯৯৭ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন।

শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেগুলো বাকি রয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অঞ্চলিক রাজনৈতিক দল (জেএসএস), জেএসএস (এমএন) ও ইউপিডিএফ।

এই তিন দল চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর জন্য অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত থাকায় চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলেও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখনও কমেনি।

পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা মানুষকে গুম করবেন, হত্যা করবেন, অস্ত্র দেখাবেন আবার অধিকারের কথা বলবেন তা হবে না। যদি পার্বত্য এলাকায় শান্তি চান তাহলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসতে হবে।

Share.

Leave A Reply