চট্টগ্রামে ‘বিদ্রোহী’ চ্যালেঞ্জে নৌকার ৭ প্রার্থীর কপালে চিন্তার ভাঁজ

0

চট্টগ্রামে মোট আসন রয়েছে ১৬টি। সবকটি আসনে এবার দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটি এবার ১১টি আসনে তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করেনি। বাকি পাঁচ আসনে নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জোট বিবেচনায় দুয়েকটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে। যদিও শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) পর্যন্ত দলের হাইকমান্ড থেকে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেষ দিনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ১৬ প্রার্থীই তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে বেশিরভাগ আসনে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরাও তাদের মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন দুই বর্তমান সংসদ সদস্য ও দলটির হেভিওয়েট কয়েকজন নেতা। অন্তত ৭টি আসনে প্রভাবশালী বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে নৌকার প্রার্থীদের।
এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে-বিএনপি জামায়াতের বিশাল ভোট-ব্যাংক রয়েছে। দিনশেষে নৌকার বিদ্রোহীদের ভাগে যেতে পারে এই ভোট-ব্যাংকের বিশাল একটি অংশ। আবার কোনো কোনো প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারলে এলাকায় অবস্থান বিদ্রোহীদের তুলনায় দুর্বল।
যদিও বিদ্রোহী হওয়া প্রার্থীরা জানিয়েছেন, গত ২৬ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা সাক্ষাৎ করতে যান। সেখানে সভাপতি বিনা ভোটে নির্বাচিত না হতে নৌকার বিরুদ্ধে ডামি প্রার্থী রাখতে বলেন। মূলত এই নির্দেশনা থেকে তারা স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানান।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জেলা রিটার্নিং কার্যালয়ে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, এ বিষয়ে সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে একটি নির্দেশনা শিগগিরই দেবেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। নির্বাচন নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কেউ নির্বাচিত না হয়, সেটা কীভাবে করা যায় এরকম একটা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা সবাই যার যার মতো ফ্রি স্টাইলে নির্বাচন করব।
চট্টগ্রাম-১
মিরসরাই উপজেলা নিয়ে আসনটি গঠিত। আসনটিতে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তবে জীবন সায়াহ্নে এসে এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন চাননি। সভাপতির কাছে অনুরোধ করে শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলে মাহবুব উর রহমানকে পাইয়ে দিয়েছেন নৌকা প্রতীক। 
আসনটিতে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন। ইতোমধ্যে তিনি মনোনয়নপত্রও জমা দিয়েছেন। মিরসরাই উপজেলায় গিয়াস উদ্দীনের বিশাল একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। আবার নৌকার প্রার্থী মাহবুব ভোটের মাঠে একেবারেই নবীন। এ হিসেবে শেষ পর্যন্ত মাঠে গিয়াস উদ্দীন মাঠে থাকলে তাকে হারানো বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে মাহবুবের।
চট্টগ্রাম-২
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন খাদিজাতুল আনোয়ার। তার সঙ্গে এবার আসনটিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবু তৈয়ব। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করেছেন।
এছাড়াও এই আসনে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। তিনি আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য। গতবার সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন।
স্থানীয়রা বলছেন, শেষ পর্যন্ত জোট বিবেচনায় আসনটি নজিবুল বশরকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবু তৈয়ব নির্বাচন না করার সম্ভাবনা রয়েছে। আর জোট বিবেচনায় নজিবুল বশরকে ছাড় দেওয়া না হয় সেক্ষেত্রে আবু তৈয়ব নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারেন। আর কোনোটিই যদি না হয় তবে তিনজন প্রার্থী ভোটের মাঠে থাকবেন। তবে আসনটিতে নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার বিরুদ্ধে একজন বা দুজন নির্বাচন করলে সেক্ষেত্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এতে করে নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
চট্টগ্রাম-৪
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড, পাহাড়তলী- আকবর শাহ আংশিক) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এস এম আল মামুন। সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে তিনি। এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করেন। তার আসনে ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম। তিনি গতবার সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার নৌকা না পেলেও তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই দুই নেতা শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে আসনটিতে ভোটের মাঠে লড়াই চলবে।
চট্টগ্রাম-৮
চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও এবং বোয়ালখালী উপজেলা (আংশিক) নিয়ে গঠিত আসনটিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন নোমান আল মাহমুদ। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত আসনটির উপ-নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। আসনটিতে এবার নির্বাচন করতে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু এবং মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম।
নগরজুড়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ কর্মীবাহিনী রয়েছে বাচ্চুর। এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামেরও অবস্থান রয়েছে আসনটিতে। যদি আওয়ামী লীগের এই দুই নেতা ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকেন তবে বিজয়ী হতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে নৌকার প্রার্থী নোমানকে। 
চট্টগ্রাম-১১
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় আসনটি। এটিতে টানা চতুর্থ-বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এম আবদুল লতিফ। ব্যবসায়ী এ নেতা এবার নৌকা প্রতীক নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। এবার তার আসনে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউল হক সুমন। তিনি চসিকের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তার পক্ষে রয়েছেন চট্টগ্রাম-১১ আসনের বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। এছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশ ভেতরে ভেতরে সাংসদ লতিফের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ রয়েছেন। এ কারণে নৌকা নিয়েও আসনটিতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন এম এ লতিফ।
চট্টগ্রাম-১২
পটিয়া উপজেলা নিয়ে আসনটি গঠিত এ আসন। এটিতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সামশুল হক চৌধুরী। দুবারই তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক পাননি। তার স্থলে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। তার পাশাপাশি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান সামশুল হক চৌধুরী। বৃহস্পতিবার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দুজনই নির্বাচনী মাঠে থাকলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
চট্টগ্রাম-১৫
সাতকানিয়া (আংশিক)-লোহাগাড়া উপজেলা নিয়ে আসনটিতে গঠিত। এই আসনে একসময় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল জামায়াতের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটিতে সর্বশেষ জামায়াতের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিল। গত দুই বার এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী। দুইবারই তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথমবার জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কোনো প্রার্থী ছিল না। দ্বিতীয় বার ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতের শামসুল ইসলাম নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী না থাকায় সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার করেন নদভী।
তবে এবার জামায়াতের কোনো প্রার্থী না থাকলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এম এ মোতালেব। তিনি উপজেলার সদ্য পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান। এছাড়াও তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার পক্ষে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিশাল একটি অংশ। তাই আসনটিতে তৃতীয়বার নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নদভীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় প্রতীকে দুই বার এমপি নির্বাচিত হলেও এমপি নদভীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর বিরোধ তৈরি হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে দলটির নেতাকর্মীর সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছেই। এ কারণে মাঠে জামায়াতের ভোট ব্যাংকের বড় একটি অংশ নদভীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর পকেটে যেতে পারে।
সবমিলিয়ে আসনটিতে এম এ মোতালেব শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশাল বহর নিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়ার মাধ্যমে সক্ষমতার জানান দিচ্ছেন এম এ মোতালেব। আবার মাঠে রয়েছে নদভীর পক্ষের লোকজন। তারা বৃহস্পতিবার এম এ মোতালেবের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ জড়ো করে ঝাড়ু মিছিল করেছেন। এভাবে আসনটিতে ধীরে ধীরে জমে উঠছে নির্বাচনী লড়াই।
Share.

Leave A Reply